ঢাকা রবিবার, ১৩ জুলাই ২০২৫

নিজামীর যত অপরাধ

নিজামীর যত অপরাধ

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ মে ২০১৬ | ১৫:১০

সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত একাত্তরে 'মইত্যা রাজাকার' হিসেবে কুখ্যাত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর জন্ম ১৯৪৩ সালের ৩১ মার্চ পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মন্মথপুর গ্রামে। ১৯৬১ সালে নিজামী তৎকালীন ইসলামী ছাত্র সংঘের (বর্তমানে ইসলামী ছাত্রশিবির) সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৬৬ সালে ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় সভাপতি হন।


একাত্তরে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নিজামীর নেতৃত্বেই হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় আলবদর বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজামীর নেতৃত্বাধীন আলবদর বাহিনীর বীভৎস গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগি্নসংযোগের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে গণতদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে। আলবদর বাহিনীই মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে জাতির সূর্যসন্তান বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করে। ইতিহাসের এ জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডেরও নেতৃত্ব দেন নিজামী।


মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের পর ঘাতক নিজামী আত্মগোপন করেন। জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর নিজামী সৌদি আরব পালিয়ে যান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর ১৯৭৭ সালে তৎকালীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে নিজামী ঢাকায় প্রকাশ্যে আসেন। ১৯৭৮ সালে নিজামী জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগরীর আমির ও
কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মনোনীত হন। ১৯৮৮ সালে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব নেন। ২০০০ সালে জামায়াতের আমির নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এলে একাত্তরের এ ঘাতককে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিপরিষদে অন্তর্ভুক্ত করে প্রথমে কৃষি ও পরে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। নিজামী শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রামের ইউরিয়া সার কারখানার জেটিতে ইতিহাসের বৃহত্তম অস্ত্রের চালান আটক করে স্থানীয় পুলিশ। পরে বিএনপি-জামায়াত জোটের সরকার এ ঘটনা ধামাচাপা দিতে মামলাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে। তবে পরবর্তী সময়ে চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার বিচারে সাক্ষ্য-প্রমাণে এ ঘটনার সঙ্গে সাবেক শিল্পমন্ত্রী নিজামীর নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এ অপরাধে ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি আদালতের রায়ে নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৪ জনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে নিজামীকে গ্রেফতার করা হয় ২০১০ সালের ২৯ জুন।


আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী আলবদর নেতা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে হত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, উস্কানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্রসহ একাধিক মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ৩(২) এর এ, বি, সি, জি ও এইচ, ৪ (১, ২) ধারায় নিজামীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অপরাধে মোট ১৬টি অভিযোগ গঠন করা হয়। তার বিরুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ও 'সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি' থাকার প্রমাণ পান ট্রাইব্যুনাল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের বিভিন্ন ধারায় এসব অভিযোগ গঠন করা হয়। এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে :
এক. পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক, আতাইকুলা থানার মাতপুর গ্রামের মাওলানা কছিমুদ্দিন স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার চালাতেন। একাত্তরের ৪ জুন পাকিস্তানি সেনারা তাকে অপহরণ করে নূরপুর পাওয়ার হাউসের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নিজামীর উপস্থিতিতে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। ১০ জুন মাওলানা কছিমুদ্দিনকে ইছামতি নদীর পাড়ে নিয়ে হত্যা করা হয়।
দুই. একাত্তরের ১৪ মে নিজামীর নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রাজাকার, আলবদররা পাবনার ডেমরা, বাউসগাতি ও রূপসা গ্রাম ঘেরাও করে। এরপর সাড়ে চার শতাধিক হিন্দুকে এক জায়গায় জড়ো করে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। সেখানে নারীদের ধর্ষণও করা হয়।


তিন. মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে মে মাসে ঢাকার মোহাম্মদপুরে শারীরিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা ক্যাম্প স্থাপনের পর গোলাম আযম ও নিজামী সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে শলাপরামর্শ করতেন। যার ফলে সারাদেশে অনেক হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।
চার. নিজামীর নির্দেশে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় একাত্তরের ৮ মে পাবনার সাঁথিয়া থানার করমজা গ্রামে লোক জড়ো করে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ নির্বিচারে অসংখ্য লোককে হত্যা ও নারীদের ধর্ষণ করা হয়।
পাঁচ. একাত্তরের ১৬ এপ্রিল ঈশ্বরদী থানার আড়পাড়া ও ভূতেরবাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে ১৯ জন নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়।


ছয়. একাত্তরের ২৭ ও ২৮ নভেম্বর পাবনার সাঁথিয়া থানার ধূলাউড়ি গ্রামে ডা. আবদুল আওয়ালের বাড়ি ও আশপাশের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ৫২ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেখান থেকে চারজনকে ইছামতি নদীর পাড়ে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। সেখানে শাহজাহান আলীকে গলা কেটে ফেলে রাখা হয়। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান।
সাত. একাত্তরের ৩ নভেম্বর রাতে নিজামীর দেওয়া তথ্যে বেড়া থানার বিছাখালী গ্রামে হামলা চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ সেলিমের বাবা আবদুস সোহরাবকে আটক করা হয়। নির্মম অত্যাচার চালানোর পর স্ত্রী ও সন্তানদের সামনে তাকে হত্যা করা হয়।


আট. মুক্তিযুদ্ধকালে ৩০ আগস্ট রাতে পুরনো এমপি হোস্টেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্পে বন্দি জালাল, রুমী, বদি, জুয়েল, আজাদসহ বেশ কয়েকজনকে হত্যার নির্দেশ দেন নিজামী। পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমার আদেশের আগেই তাদের হত্যা করতে হবে। এরপর জালাল বাদে তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়।
নয়. নিজামী ও রাজাকার বাহিনীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বৃশালিখা গ্রাম ঘিরে ফেলে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রফুল্ল, মানু, ভাদু, স্বস্তি প্রামাণিক, জ্ঞানেন্দ্রনাথ হালদার ও পুতুলসহ ৭০ জনকে হত্যা করা হয়। ৭০ বাড়িতে আগুন জ্বালানো হয়।


দশ. মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে পাবনার সোনাতলা গ্রামের অনিলচন্দ্র কুণ্ডু নিরাপত্তার জন্য সপরিবারে ভারতে চলে যান। পরে তিনি আগস্ট মাসে ফিরে আসেন। তার ও গ্রামের অন্যদের বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
এগারো. একাত্তরের ৩ আগস্ট নিজামী চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে শহর ছাত্র সংঘের এক সুধী সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। সেখানে পাকিস্তান রক্ষার পক্ষে বক্তব্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র সংঘের সভাপতি আবু তাহের হিন্দু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার আদেশ দেন। নিজামী ওই সভায় নিজেও বক্তব্য রাখেন এবং আবু তাহেরের বক্তব্যের মৌন সম্মতি দেন।
বারো. একাত্তরের ২২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক একাডেমি হলে আল-মাদানী স্মরণসভায় বক্তব্য রাখেন নিজামী। এ সভায় দলীয় নেতাকর্মীদের স্বাধীনতাকামী ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিশ্চিহ্ন করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। এরপর তারা সারাদেশে সংঘটিত হয়ে অপরাধ করতে থাকে। এসব ঘটনার দায় নিজামীর ওপর বর্তায়।


তেরো. একাত্তরের ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন প্রাঙ্গণে এক ছাত্র সমাবেশে উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখেন নিজামী। তিনি বলেন, 'পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় হিন্দুস্তানের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতে রাজাকার, আলবদর সদস্যরা প্রস্তুত। মুক্তিকামী বাঙালিরা ভারতের সহযোগী।'
চৌদ্দ. একাত্তরের ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর যশোর বিডি হলে ইসলামী ছাত্র সংঘের সভায় নিজামী তার বক্তব্যে জিহাদের সমর্থনে আল কোরআনের একটি আয়াত উল্লেখ করে নিরীহ স্বাধীনতাকামী বাঙালি জনগণকে হত্যার নির্দেশ দেন।
পনেরো. একাত্তরের ৫ মে থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে নিজামী পাবনার সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে রাজাকার ক্যাম্পে যাতায়াত করতেন। এ সময় তিনি রাজাকার কমান্ডার সামাদ মিয়ার সঙ্গে বৈঠক করে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের শলাপরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করতেন।


ষোলো. আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিজামী একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের আগে সংঘটিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন।
রায় : নিজামীর বিরুদ্ধে থাকা ষোলোটি অভিযোগের মধ্যে ৮টি অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের রায়ে প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া ১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে হত্যা, আটক ও নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র সংঘটনের দায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বাকি ৮ অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে না পারায় খালাস দেওয়া হয় এই যুদ্ধাপরাধীকে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তিনটি (২, ৪ ও ১৬) অভিযোগে নিজামীর সাজা মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। গতকাল নিজামীর দণ্ড ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর হয়েছে।

আরও পড়ুন

×