ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

সরব এশিয়া-ইউরোপ

মুক্তিযুদ্ধে বন্ধু রাষ্ট্র ৫

সরব এশিয়া-ইউরোপ

আবু সালেহ রনি

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮ | ১৯:৪৭

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নৃশংসতায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ইউরোপ ও এশিয়ার শুধু বিশ্বনেতারাই নন, সাধারণ জনগণও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তারা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনকারী দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিরুদ্ধেও ভূমিকা রেখেছিলেন। এভাবে ইউরোপ-এশিয়ার বিশ্বনেতা ও সাধারণ জনগণের একাত্ম ভূমিকা বাঙালিদের যুদ্ধজয়ে অনুপ্রেরণা ও শক্তির অন্যতম উৎস হয়ে উঠেছিল। তবে পাকিস্তানের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে অধিকাংশ মুসলিম দেশই অবস্থান নেয় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে।

পাকিস্তান সরকার বিদেশি সাংবাদিকদের কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখলেও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই তাদের গণহত্যা ও নৃশংসতার খবর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম নৃশংসতার খবর গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ পায় লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায়। মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের লেখা এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ পায় ৩০ মার্চ।

মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বিশ্বজনমত সৃষ্টি ও ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে একাত্তরের ১ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের ম্যাডিসন স্কয়ারে অনুষ্ঠিত হয় 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'। কিংবদন্তিতুল্য ভারতীয় বাঙালি সঙ্গীতজ্ঞ পণ্ডিত রবিশংকর তার শিষ্য বন্ধু বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড বিটলসের শিল্পী জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে এই অবিস্মরণীয় কনসার্টের আয়োজন করেন। এ ছাড়া এ কনসার্টে অংশ নেন ওস্তাদ আলী আকবর খান, ওস্তাদ আল্লা রাখা খান, বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, রিঙ্গো স্টার প্রমুখ। কনসার্টে ৪০ হাজার শ্রোতার সমাগম হয়। কনসার্ট থেকে অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৫ হাজার মার্কিন ডলার। কিন্তু সেদিন সংগৃহীত হয় প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার, যা ছিল অভাবনীয়। কনসার্টের সার্বিক তত্ত্বাবধানকারী ইউনিসেফ সংগৃহীত অর্থ বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য ব্যয় করে।

রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক সমকালকে বলেন, 'উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মতাদর্শ অর্থাৎ পলিসির সঙ্গে যুক্ত ছিল। তবুও সেসব দেশের জনগণ বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। বিশ্বখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী জর্জ হ্যারিসনও তাদের একজন। 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' আয়োজনের মধ্য দিয়ে তিনি সারাবিশ্বকে বাংলাদেশের পক্ষে নিয়ে আসতে ভূমিকা রাখেন, যা মুক্তিযুদ্ধের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।'

নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার ছাড়াও ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশে বাঙালি শরণার্থীদের তহবিল সংগ্রহের জন্য কনসার্টের আয়োজন করা হয়। ১৯৭১-এর ১৮ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের কেনিংটন ওভাল মাঠে রক কনসার্টের আয়োজন করে ব্যান্ড দল 'রিকি ফার'। 'কস্তুর' নামে একটি দাতব্য সংগঠনের আয়োজনে এ কনসার্টের টিকিটের মূল্যমান ছিল দেড় পাউন্ড। বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল 'বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য।' ধারণক্ষমতা ৩০ হাজার হলেও ওভালে সেদিন ৪০ হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত ও ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনায় দেখা যায়, বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন এশিয়ার জাপান এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিউবা, যুগোস্লাভিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া এবং পূর্ব জার্মানির রাষ্ট্রপ্রধান ও সাধারণ জনগণ। বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে সহযোগিতা করে অস্ট্রেলিয়া, পশ্চিম জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, মিসর ও কানাডার বিভিন্ন গণমাধ্যম। তবে মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশই পাকিস্তানের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্যে পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে পদত্যাগকারী সেকেন্ড সেক্রেটারি, পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মহিউদ্দিন আহমদ সমকালকে বলেন, 'পাকিস্তান সরকার মুসলিম দেশগুলোকে বুঝিয়েছিল, হিন্দু অধ্যুষিত ভারতের ইন্ধনে পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশে) নাশকতা হচ্ছে। কারণ ভারত পূর্ব পাকিস্তান দখল করতে চায়। তবে পাকিস্তান সরকার নাশকতা মোকাবেলায় তৎপর রয়েছে। পাকিস্তান সরকারের এ অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়েই মূলত মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন সমকালকে বলেন, 'মুসলিম বিশ্ব বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। তখন ওআইসিতেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাস করা হয়েছিল। কারণ পাকিস্তান সরকার তাদের ভুল বুঝিয়েছিল, যা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুসলিম বিশ্বের কাছে পরিস্কার হয়। এ কারণে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই মিসর, ইন্দোনেশিয়াসহ কয়েকটি মুসলিম দেশ স্বীকৃতি দিয়েছিল।'

ইউরোপের ভূমিকা প্রসঙ্গে আনোয়ার হোসেন বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও মার্কিন জনগণ এবং এডওয়ার্ড কেনেডিসহ কয়েকজন মার্কিন রাজনৈতিক বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে ও অন্যান্যভাবে সহায়তা করে।' তিনি জানান, ফরাসি দার্শনিক আঁদ্রে মার্লো তখন নভেম্বরের শেষদিকে বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করার ঘোষণাও দিয়েছিলেন।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা বন্ধ এবং ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের ত্রাণ ও অর্থ সহায়তার জন্য মুক্তিযুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন জাপানের ডায়েটের প্রভাবশালী সদস্য হায়াকাওয়া। তিনি নৃশংস হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ জানিয়ে জাপান সরকার ও স্থানীয় জনগণের প্রতিবাদ জানানোর এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়ানোর প্রেক্ষাপট তৈরি করেন। তার সাংগঠনিক উদ্যোগেই জাপানের বিভিন্ন গণমাধ্যম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গুরুত্ব সহকারে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ প্রসঙ্গে সাবেক সচিব মহিউদ্দিন আহমদ সমকালকে বলেন, 'এশিয়ার মধ্যে জাপান সরকার ও জনগণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। সাধারণ জনগণ বিভিন্ন সাংগঠনিক কার্যক্রমের মাধ্যমে যুদ্ধরত বাঙালিদের জন্য অর্থ ও ত্রাণ সহায়তা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছে। পরে জাপান সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের বিষয়ে তাৎপর্যপুর্ণ ও সুদূরপ্রসারী কূটনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়।'

ইউরোপের ভূমিকা প্রসঙ্গে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, 'ইউরোপীয় দেশগুলোর অধিকাংশই বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়। বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের দেশ সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী ওলফ পামে, পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর (প্রধানমন্ত্রী) উইলি ব্র্যান্ড, অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর ব্রুনো ক্রাইসকি প্রমুখ বিশ্বনেতা সরাসরি বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বক্তব্যকে সমর্থন করে। পূর্ব ইউরোপের তৎকালীন সোভিয়েত ব্লকভুক্ত বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডোও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অনন্য ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতার চার দশক পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ পিয়েরে ট্রুডোকে মরণোত্তর মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।'

একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ এবং বাঙালি শরণার্থীদের সহায়তায় এগিয়ে এসে আলোড়ন সৃষ্টি করেন ফ্রান্সের নাগরিক জ্যঁ ইউজিন পল ক্যুয়ে। তিনি ওইদিন ব্যাগে বোমা ও হাতে রিভলবার নিয়ে ফ্রান্সের প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দরে দাঁড়ানো পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজের একটি বোয়িং ৭২০ বিমানের ককপিটে উঠে পড়েন এবং বিমান হাইজ্যাক করেন। এ অবস্থায় বিমানটিকে পাঁচ ঘণ্টা রানওয়েতে আটকে থাকতে হয়। তার দাবি ছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী যুদ্ধরত মানুষ, বিশেষত ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের সাহায্যার্থে ২০ টন মেডিকেল সামগ্রী বিমানটিতে তুলে পাঠাতে হবে।

এ প্রসঙ্গে কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক বলেন, 'পাকিস্তানের বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা বিশ্ব তোলপাড় করেছিল। অবশ্য পরে ফ্রেঞ্চ কমান্ডো জ্যঁ পল কুয়েরকে গ্রেফতার করে এবং বিচারে তার ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়।'

আরও বেশ কয়েকটি দেশের সাধারণ জনগণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, যা বাঙালি জাতিকে কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করে রেখেছে।

আরও পড়ুন

×