ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

সরেজমিন

উত্তাপের সঙ্গে মিশে আছে উত্তেজনাও

ঢাকা-১

উত্তাপের সঙ্গে মিশে আছে উত্তেজনাও

সাব্বির নেওয়াজ ও মাহবুবুর রহমান টিপু দোহার থেকে

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮ | ১৯:৫০

সারাদেশের ৩০০ নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ঢাকা-১ আসন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ ও দোহার উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনে পুরুষের চেয়ে নারী ভোটারের সংখ্যা বেশি। মোট ৪ লাখ ৪০ হাজার ২৮৭ ভোটারের মধ্যে ২ লাখ ২৩ হাজার ৪৯৩ জনই নারী।

কেন এ আসনে নারী ভোটার বেশি?- এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, এই দুই উপজেলার বেশিরভাগ যুবকই প্রবাসী। তাদের বড় একটি অংশ কাজ করছেন সৌদি আরবে। তাদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বসবাস সিঙ্গাপুরে। এর বাইরে কুয়েত, দুবাই আর মালয়েশিয়ায়। অন্যান্য দেশেও আছেন। দুই উপজেলার বেশিরভাগ বাড়িরই অন্তত একজন পুরুষ বিদেশে কাজ করছেন। ফলে ভোটার লিস্টে নারীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর সঙ্গত কারণেই নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা মন কাড়তে চাচ্ছেন নারী ভোটারদের।

রাজধানী ঢাকা থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরের উপজেলা দোহার। নবাবগঞ্জের সঙ্গে দূরত্ব অবশ্য আরও কম। আধা শহর, আধা গ্রামের মিশেলে গড়ে ওঠা এই জনপদের এ দুই উপজেলায় আসতে পথের দু'পাশে হলুদ-সবুজে মেশানো সরিষা ক্ষেতের ছড়াছড়ি। ভোরের কুয়াশার রেশ কাটেনি তখনও। প্রকৃতি আড়মোড়া ভেঙে পুরোপুরি জেগে ওঠার আগেই আগলা বাজার পার হয়ে পৌঁছা হয় নবাবগঞ্জ উপজেলার বেণুখালী-টিকেরপুর

এলাকায়। সেখানে মূল সড়ক মেরামতের কাজ করছিলেন দিনমজুর আশরাফ আলী মিয়া। তিনি চুড়াইন ইউনিয়নের শিবরামপুর গ্রামের বাসিন্দা। তার সরল মন্তব্য, 'এই এলাকায় নির্বাচন হইতেছে ট্যাকাওয়ালা গো নির্বাচন। ট্যাকায় ট্যাকায় টক্কর হইবো।'

তার এই মন্তব্যের মূল কারণ হলো, দেশের শীর্ষ দুই শিল্প গ্রুপের দুই কর্ণধার এ আসনে প্রার্থী হয়ে আলো ছড়াচ্ছেন। তারা হলেন- আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মোটরকার প্রতীকের যমুনা গ্রুপের পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম। তিনি এ নির্বাচনী এলাকার বর্তমান সাংসদ। এই দু'জনের সঙ্গে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আবির্ভূত হয়েছেন নবাবগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে সদ্য পদত্যাগ করা বিএনপির ধানের শীষের প্রার্থী আবু আশফাক। ফলে এ আসনে আরও প্রার্থী থাকলেও মূলত লড়াই হবে এই তিনজনের মধ্যেই। ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ার পর থেকে আনুষ্ঠানিক প্রচারে নেমেছেন তারা। নির্বাচনের পরিবেশ এতদিন শান্তই ছিল। তবে গত বুধবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মুখোমুখি হয়ে যাওয়ার পর বিএনপির মিছিল থেকে আক্রমণে আওয়ামী লীগের চারজন কর্মী আহত হওয়ায় এলাকায় নির্বাচনী উত্তাপের সঙ্গে ছড়িয়েছে উত্তেজনাও। গতকাল বৃহস্পতিবার দিনভর এ উত্তেজনা লক্ষ্য করা গেছে দু'দলের নেতাকর্মীদের মাঝে। দোহার উপজেলা আওয়ামী লীগ গতকাল বিক্ষোভ মিছিল করেছে এ ঘটনায়। দোহার থানা পুলিশ বিএনপির ১৬৩ জনের নাম উল্লেখ করে আরও অজ্ঞাত ৫০০ জনকে আসামি করে দুটি মামলাও করেছে। এরই মধ্যে বিএনপির ১৮ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।

নবাবগঞ্জের আগলা বাজার এলাকার বাসিন্দা কাওসার হোসেন কমেটের মতে, এই নির্বাচনী এলাকায় মানুষ অনেক বেশি শান্তিপ্রিয়। তারা নিরাপদে ও সুষ্ঠু পরিবেশে ভোট দিতে চায়।

সরেজমিন দেখা গেছে, নির্বাচনী প্রচারে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সালমান এফ রহমান। নির্বাচনী এলাকাজুড়ে তার পোস্টার চোখে পড়ার মতো। বাকি দুই প্রার্থীর পোস্টার চোখে পড়ল না। তবে সব প্রার্থীর পক্ষে গ্রামে গ্রামে উঠান বৈঠক, গণসংযোগ, কর্মিসভার মাধ্যমে ভোট প্রার্থনা চলছে।

নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা একজন প্রার্থী তার কর্মীদের মাঝে দোহার ও নবাবগঞ্জে প্রায় দুই শতাধিক মোটরসাইকেল বিতরণ করেছেন বলে অভিযোগ করলেন দোহার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আলমগীর হোসেন। তিনি এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এটি আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এটা দুঃখজনক।

জাতীয় সংসদের ১৭৪, ঢাকা-১ আসনটি জেলার দোহার ও নবাবগঞ্জ নিয়ে গঠিত। দুই উপজেলার মধ্যে নবাবগঞ্জ উপজেলায় ভোটার সংখ্যা বেশি। দোহারে মোট ভোটার ১ লাখ ৭৮ হাজার ৪৭৭ জন। নবাবগঞ্জে ভোটার ২ লাখ ৬১ হাজার ৮৮৪ জন। মোট ভোটকেন্দ্র ১৭৭টি। এ ছাড়া অস্থায়ী ভোটকেন্দ্র আছে ১৫টি।

স্বাধীনতার পর '৯০-এর আগ পর্যন্ত এই আসনে কোনো দলেরই একক আধিপত্য ছিল না। এ আসনটিতে দেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি প্রত্যেকে দু'বার করে বিজয়ী হয়েছে। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের আবু মোহাম্মদ সাইদুর রহমান, ১৯৭৯ সালে বিএনপির খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির শহীদ খন্দকার, ১৯৯১ সালে বিএনপির নাজমুল হুদা, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান ও ২০১৪ সালে জাতীয় পার্টির সালমা ইসলাম এ আসনে বিজয়ী হন।

ঢাকা-১ আসনে সালমা ইসলাম এবং সালমান এফ রহমানের মধ্যেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে প্রথমে মনে করা হচ্ছিল। তবে বিএনপির প্রার্থী খন্দকার আবু আশফাকের শক্ত অবস্থান ও গত বুধবার দোহারে বিএনপির নির্বাচনী শোডাউন, এখানে জমজমাট ভোটযুদ্ধকে কঠিন লড়াইয়ে পরিণত করছে।

নৌকা প্রতীকের সালমান এফ রহমানের বাড়ি দোহার উপজেলার মুকসুদপুর ইউনিয়নের শাইনপুকুর গ্রামে। সল্ফ্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান সালমানের বাবাও মন্ত্রী ছিলেন। তিনি এলাকার শিক্ষা, সামাজিক উন্নয়ন ও জনসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এর আগে বিনামূল্যে দোহারে ২৪০টি আর্সেনিকমুক্ত টিউবওয়েল স্থাপন, মেধাবী ছাত্রদের মাঝে বৃত্তি প্রদান, কন্যা দায়গ্রস্তদের আর্থিক অনুদান, অভাবগ্রস্তদের সাহায্য-সহযোগিতা ও চিকিৎসাসেবা প্রদান ছাড়াও বহু স্কুল-কলেজে কম্পিউটার দিয়েছেন তিনি।

সালমা ইসলাম মহাজোটের অন্যতম অংশীদার জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য। এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্যও তিনি। তবে সালমা ইসলামের সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো তিনি দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টেলিভিশনের অন্যতম কর্ণধার। শিল্পপতি ও যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুল তার স্বামী। জাতীয় পার্টি ও মহাজোটের নানা হিসাব-নিকাশের কারণে সালমা ইসলাম নিজ দল থেকে মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মোটরগাড়ি নিয়ে নির্বাচনে লড়ছেন তিনি। নবাবগঞ্জ উপজেলার চুড়াইন ইউনিয়নের কামারখোলা গ্রামে তার বাড়ি।

বিএনপির প্রার্থী আবু আশফাকের বাড়ি নবাবগঞ্জ উপজেলার কলাকোপা ইউনিয়নের কলাকোপা পুকুরপাড় গ্রামে। তিনি দু'বার নবাবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন।

ভোটাররা বলছেন, সালমান, সালমা এবং আশফাক তিনজনেরই জনপ্রিয়তা রয়েছে। এর আগে সালমান এবং সালমা দু'জনই ঢাকা-১ আসন থেকে একবার করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।

সংশ্নিষ্টরা যা বলেন : আওয়ামী লীগ প্রার্থী সালমান এফ রহমানের পক্ষে নির্বাচনী মাঠ দৌড়ে বেড়াচ্ছেন দোহার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আলমগীর হোসেন। উপজেলা পরিষদে বসেই কথা হলো তার সঙ্গে। তিনি বলেন, বিজয়ের ব্যাপারে আমরা শতভাগ আশাবাদী। গত ১০ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার সারাদেশে যে উন্নয়ন করেছে, সেই উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় আসন্ন নির্বাচনে নৌকা মার্কাকে এ দেশের জনগণ ভোট দিয়ে আবারও শেখ হাসিনাকেই রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরিয়ে আনবে।

স্বতন্ত্র প্রার্থী সালমা ইসলাম তার মেয়াদে দোহার-নবাবগঞ্জে উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে ভোটারদের কাছে ভোট চাচ্ছেন। তিনি আবারও নির্বাচিত হলে এই দুই উপজেলাকে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।

বিএনপির প্রার্থী আবু আশফাক বলেন, সুষ্ঠু ভোট হলে আমিই বিজয়ী হবো। এ নির্বাচন ৫ জানুয়ারির চেয়েও ভয়াবহ খারাপ। গত বুধবার নির্বাচনী প্রচারকালে আমাকে বিনা মামলায় আটক করে ন্যক্কারজনক নজির গড়েছে তারা। আমার প্রচার সঙ্গীদেরও আটক করে মামলা দেওয়া হয়েছে তাদের নামে। আমাদের নির্বাচন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার নির্বাচন।

প্রধান ইস্যু পদ্মার ভাঙন : প্রমত্তা পদ্মার ভাঙনে ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে দোহারের মানচিত্র। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পদ্মা তীরবর্তী দোহার উপজেলার নদীভাঙন রোধ করা এবারের নির্বাচনে তাই ভোটারদের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এ অঞ্চলের ভাঙনকবলিত মানুষগুলো চর অঞ্চলে বসবাস করে। প্রতিবার ভোটের সময় প্রার্থীরা তাদের কেবলই আশ্বাসের বাণী শোনান। বিভিন্ন নির্বাচনে প্রার্থীরা নিজের জমি হবে, রাস্তা হবে, স্কুল হবে- এমন সব প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ঝরালেও কথা রাখেননি কেউই। ফলে এ চর অঞ্চলের মানুষ নিরক্ষতার পাশাপাশি অস্বাস্থ্য ও অপুষ্টিতে ভুগছে। সরেজমিন দেখা গেছে, নারিশা ইউনিয়নের মেঘুলা, নারিশা জোয়ার, পশ্চিমচর, রানিপুর, সুতারপাড়া ইউনিয়নের মধুরচর, কাজিরচর, বিলাশপুর ইউনিয়নের বিলাশপুর, মাঝিরচর, নয়াবাড়ি ইউনিয়নের ৭-৮টি গ্রাম ও মাহমুদপুর ইউনিয়নের ৩-৪টি গ্রাম এর মধ্যে পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। এসব গ্রামের বাসিন্দারা চরে আশ্রয় নিয়েছে। মধুরচর নিবাসী অলি আহম্মেদ বলেন, 'পদ্মার ভাঙন রোধে কার্যকর উদ্যোগ যারা নেবেন, জনরায় তাদের পক্ষেই যাবে।'

আরও পড়ুন

×