ডেঙ্গু পরিস্থিতি
বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা খরচ পাঁচ গুণ

তবিবুর রহমান
প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০
সরকারির চেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসার খরচ দিন-রাতের ফারাক। এডিস মশাবাহিত এ রোগ নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে পা রাখলেই খরচাপাতি বাড়ে অন্তত পাঁচ গুণ। সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুর সাধারণ চিকিৎসায় এক রোগীর খরচ যেখানে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা, সেখানে বেসরকারি হাসপাতালে অন্তত লাখ টাকা। দেশের সর্বোচ্চ মানের বেসরকারি হাসপাতালে এ খরচ গিয়ে ঠেকে ৩ থেকে ৪ লাখে।
একই রোগের চিকিৎসা খরচে এত বড় ব্যবধান অযৌক্তিক মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ডেঙ্গু রোগীর ক্রমবর্ধমান বিস্তারের পাশাপাশি চিকিৎসা খরচও উদ্বেগজনক। বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয় নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি হাসপাতালে তদারকি বাড়ানো দরকার। নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সরকারি বা বেসরকারি– যেখানেই ভর্তি থাকুক, ডেঙ্গু রোগীর খরচ বাড়াচ্ছে অ্যাপারেসিস প্লাটিলেট। যাদের প্লাটিলেট ২০ হাজারের নিচে নেমে যাচ্ছে, তাদের ১ থেকে ৩ ব্যাগ পর্যন্ত প্লাটিলেট নিতে হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যাধুনিক মেশিনের মাধ্যমে সংগ্রহ করা ১ ব্যাগ প্লাটিলেটের দাম ১৪ হাজার টাকা। বেসরকারিতে যা ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।
এ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গতকাল শুক্রবার ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে নতুন ভর্তি হয়েছেন ৪৪৬ জন। আশার খবর হলো, গত তিন দিনের চেয়ে রোগীর সংখ্যা অনেকটাই কম। এ সময়ে কারও মৃত্যু হয়নি।
চিকিৎসা খরচে নেই লাগাম
ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ায় স্ত্রীকে তিন দিন আগে রাজধানীর মুগদা সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন রিকশাচালক আজিজ মিয়া। পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধ, রোগীর খাবার, যাতায়াত– সব মিলে এরই মধ্যে খরচ হয়ে গেছে ১৫ হাজার টাকা। চিকিৎসক জানিয়েছেন, সুস্থ হতে আরও কয়েকদিন লাগবে। আজিজ মিয়া বলেন, হঠাৎ এত টাকা জোগাড় করতে না পারায় এক আত্মীয় থেকে ঋণ করেছি। একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন যাত্রাবাড়ীর রাসেল আহমেদ আইসিইউতে ১৩ দিন চিকিৎসা নিচ্ছেন। রাসেলের স্বজন জানিয়েছেন, সরকারি হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও অনেক পরীক্ষা বাইরে থেকে করতে হয়। ফলে এই রোগীর খরচ ৫০ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। শুধু রক্ত থেকে প্লাটিলেট আলাদা করতে খরচ হয়েছে ১৪ হাজার টাকা। এমন খরচ মধ্যবিত্ত এই পরিবারের পক্ষে টানা খুবই কষ্টকর।
পুরান ঢাকার আতাউর রহমান এ মাসের প্রথম সপ্তাহে রাজধানীর আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ওই হাসপাতালে মাত্র দু’দিন ভর্তি থাকায় তাঁকে ১ লাখ টাকা গুনতে হয়। নিরুপায় হয়ে সুস্থ হওয়ার আগেই হাসপাতাল ছাড়েন আতাউর। তাঁর স্বজনের অভিযোগ, সুযোগ বুঝে রোগীর পকেট কাটছে বেসরকারি হাসপাতাল। অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করানো হচ্ছে। জটিলতা না হলেও প্লাটিলেট দেওয়া হয়েছে আতাউরকে।
রাজধানীর একাধিক হাসপাতালে ঘুরে দেখা গেছে, ডেঙ্গু রোগীকে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে চার থেকে সাত দিন হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। চিকিৎসক ফি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধ, যাতায়াত খরচ, হাসপাতাল বিল মিলে সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেসরকারিতে পাঁচ গুণ টাকা লাগছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক ডা. মাসুদা বেগম বলেন, জটিল রোগীর ক্ষেত্রে অ্যাপারেসিস প্লাটিলেট প্রয়োজন হচ্ছে। জটিল সময়টা পার করতে রোগীকে অন্তত তিন থেকে চার ব্যাগ প্লাটিলেট দেওয়া লাগছে। এ ক্ষেত্রে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকার খরচ আসছে।
বর্তমানে বেসরকারিভাবে সর্বোচ্চ ১৩৬ ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছে হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল। এ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. মোরশেদ বলেন, একজন ডেঙ্গু রোগী সুস্থ হয়ে উঠতে গড়ে ৫০ হাজার টাকার মতো খরচ হচ্ছে। অনেকের এখন অ্যাপারেসিস প্লাটিলেট লাগে। তাদের খরচ আরও বেশি। অধিকাংশ রোগীর ‘শক সিনড্রোম’ দেখা দেওয়ায় বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়। ফলে রোগীর স্বজনরা অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার অভিযোগ তুলছেন।
এদিকে গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ ২০৭ জন ডেঙ্গু রোগীর ৮ দিনের খরচের তথ্যের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে হাসপাতালভেদে ৮ দিনে রোগীদের সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক নাসরিন সুলতানা বলেন, বেসরকারি এ ক্যাটাগরি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় খরচ প্রায় ৪ লাখ টাকা, দ্বিতীয় ক্যাটাগরির হাসপাতালে এ খরচ ২ লাখ টাকা।
তবে খরচের এই হার অস্বাভাবিক বলে দাবি করেছেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা। অধ্যাপক ডা. এইচ এ এম নাজমুল আহাসান বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের প্যারাসিটামল আর স্যালাইন ব্যবহার বেশি হয়। এতে খরচ খুব কম। শেষের চার দিন রোগীর শারীরিক অবস্থার নিবিড় পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন হলেও তাতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধ খরচ লাখ ছাড়ানো কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসার খরচ পর্যালোচনা করে কারা অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা এবং ওষুধ কিনতে রোগীদের বাধ্য করছে, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা জরুরি।
জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি যদি ৫০ টাকা হয়, বেসরকারি হাসপাতাল ১০০ টাকা হওয়ার কথা। তবে সরকারি-বেসরকারিতে পরীক্ষা ফি ১০ গুণ, অর্থাৎ ৫০০ টাকা করে কীভাবে। এ ছাড়া বেসরকারি হাসপাতালে বেশিরভাব পরীক্ষার ফি অনির্ধারিত। এর সুযোগও নেয় হাসপাতালগুলো।
এ বছর ৯৩ জনের মৃত্যু
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, এ বছর গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৯৩ জন। এর মধ্যে জুলাইয়ের দুই সপ্তাহে মৃত্যু হয়েছে ৪৬ জনের। শেষ ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন বেশি। এ সংখ্যা ২৬৫ জন। এ সময় ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৮৪ জন। জুলাইয়ের এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯ হাজার ৮৫৩ জন। সব মিলিয়ে এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ১৭ হাজার ৮৮১। গতকাল পর্যন্ত হিসাবে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৪ হাজার ২২০ জন। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকার ৫৩ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী রয়েছেন ২ হাজার ৭৭৫ জন।
- বিষয় :
- ডেঙ্গু