অগ্রাধিকার খাত ৫ নারী উন্নয়ন
সম্পদে নারীর সমান অধিকার চাই
বিশেষ সাক্ষাৎকার : রোকেয়া কবীর
নাহিদ তন্ময়
নারীর ক্ষমতায়ন, সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়ন দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক,
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পরিকল্পনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তবে
তার ক্ষমতায়নের প্রথম ও প্রধান শর্ত, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। আর এ স্বাধীনতা
নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই সম্পদে নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
সমকালের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত নারীর অধিকার আদায়
আন্দোলনে সক্রিয় নারীনেত্রী রোকেয়া কবীর এ কথা বলেছেন।
তিনি বলেছেন, সমাজ, পরিবার, রাষ্ট্র সবক্ষেত্রে সমানভাবে ক্ষমতায়িত হলে
নারীর প্রতি সহিংসতা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। সরকার নারী উন্নয়ন ও
ক্ষমতায়নে আইন প্রণয়নসহ অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করছে।
তারপরও প্রশ্ন উঠছে, এসব পদক্ষেপ নারীর ক্ষমতায়ন বা উন্নয়নে কতটা ভূমিকা
রাখছে। কারণ পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্র কোনোখানেই বৈষম্য নারীর
পিছু ছাড়ছে না।
নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক, মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া কবীর বলেন,
বর্তমানে নারীর ক্ষমতায়নকে সামাজিক উন্নয়নের সূচক হিসেবে ধরা হয়। স্বীকার
করতেই হয় আওয়ামী লীগ সরকার নারীর ক্ষমতায়নে-উন্নয়নে রেকর্ড পরিমাণ কাজ
করেছে। এই সরকার নারীবান্ধব সরকার। মোটাদাগে বললে শিক্ষা, স্বাস্থ্য,
কর্মক্ষেত্র সর্বত্রই নারীর অগ্রসর দৃশ্যমান। তবে সরকার বা বিভিন্ন উন্নয়ন
সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত তথ্য বিশ্নেষণ করলেই এ-ও দেখা যায়, সিদ্ধান্ত
গ্রহণের জায়গায় নারীর অংশগ্রহণ নেই। আসলে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য রাজনৈতিক
অঙ্গীকার জরুরি। চলমান কাজের ধারার কিছু পরিবর্তন জরুরি। আর বৈষম্য নিরসন
করে ক্ষমতায়ন ঘটানোর সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হলো, সম্পদে নারীর সমান
অধিকার। রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকলে সরকারের পক্ষে এ ধরনের কাজ করা অনেকটাই
সহজ হয়। আর বৈষম্যের বীজ রোপণ হয় পরিবার থেকে- সম্পদে সমান অধিকার না থাকার
কারণে। দেশের পারিবারিক আইনগুলোতে এখনও সম্পত্তির উত্তরাধিকার, বিয়ে, বিয়ে
বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব- সব ক্ষেত্রেই নারীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে।
রোকেয়া কবীর বলেন, পারিবারিক আইন এখনও ধর্মভিত্তিক রয়ে গেছে- এটা
বৈষম্যমূলক। এ ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দলেরই দায়বদ্ধতা রয়েছে। তবে তারপরও
বলি, এ নিয়ে আমার মধ্যে হতাশা নেই। নিশ্চয়ই সব ধরনের বৈষম্যের নিরসন হবে,
নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত হবে। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত
হোসেনের সেই আন্দোলনের সময় থেকে শুরু বর্তমান সময় পর্যন্ত বিশ্নেষণ করলে এ
বিশ্বাস আরও তীব্র হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সংস্থার জরিপের উদাহরণ দিয়ে রোকেয়া
কবীর জানান, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও শীর্ষপদে নারীর উপস্থিতি
কম। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ যেমন বেশি, বঞ্চনাও প্রচুর। কর্মক্ষেত্রে
শীর্ষপদে নারী নিয়োগের হার সর্বোচ্চ ছয় থেকে সাত শতাংশ। সিদ্ধান্ত
নির্ধারণের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। মূলত গার্মেন্ট
সেক্টরেই নারীর অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি। এর অন্যতম কারণ পুরুষের তুলনায়
নারীকে কম বেতনে নিয়োগ করা যায়। যেখানে বেতন কম, সেখানেই নারী শ্রমিক বেশি।
এটা নারী পুরুষের দৃশ্যমান একটি বৈষম্য। শহরের তুলনায় গ্রামের নারীরা
ভয়ঙ্করভাবে এ বৈষম্যর শিকার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো, নারী পুরুষের বৈষম্য
কমিয়ে আনা। এ চেতনাকে ধারণ করে এ বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে। এ জন্য
সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে।
নারীর বিরুদ্ধে ধর্মীয় মৌলবাদ ভয়ঙ্করভাবে কাজ করছে জানিয়ে রোকেয়া কবীর
বলেন, ওয়াজ-মাহফিল এমনকি মসজিদের খুতবায়ও এক শ্রেণির ধর্মান্ধ নারীর
বিরুদ্ধে নানা কথা বলে আর উপস্থিত পুরুষরাও খুব মনোযোগ দিয়ে এসব বক্তব্য
শোনে। নারীর বিরুদ্ধে ওয়াজ মাহফিলে যেভাবে কথা বলা হয়, তা যদি দুর্নীতির
বিরুদ্ধে বলা হতো, তবে পুরুষ সমাজ মুহূর্তেই সে আয়োজন বন্ধ করে দিত। মূলত
পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণেই নানা ফরমেটে একটি গোষ্ঠী নারীর বিরুদ্ধে
কথা বলছে। এ গোষ্ঠী ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে সব কাজে ব্যবহার করে। তারাই
আবার ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে সম্পদের সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত করে,
নির্যাতন করে। এ অবস্থা পাল্টাতে পাঠ্যপুস্তকে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি
হয়, এমন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মানসিকতার পরিবর্তনের জন্য সাংস্কৃতিক
কার্যক্রম ব্যাপকহারে বাড়াতে হবে।
নারীর জন্য কোটা সংরক্ষণ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে রোকেয়া কবীর
বলেন, দেশে নারীর এই দৃশ্যমান অগ্রগতির পেছনে কোটা একটি বড় ভূমিকা রেখেছে।
সামাজিক-পারিবারিক অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে নারীরা পড়াশোনা করেন।
সভা-সেমিনারে ও সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণেও রয়েছে নানা বাধা। তাই
চাকরিতে নারীর জন্য কোটা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের শর্তের বিষয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)
অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে সব ধরনের রাজনৈতিক কমিটিতে ৩৩ শতাংশ পদে নারী
নেতৃত্ব নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। নারী অধিকার আদায়ে আন্দোলনরত
সংগঠনগুলোও দীর্ঘদিন ধরে এ দাবি জানিয়ে আসছে। এ প্রসঙ্গে রোকেয়া কবীর
জানান, শুধু দাবি নয়- রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ নিয়ে একাধিকবার আলোচনা
হয়েছে। তাদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। এমনকি নির্বাচন
কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। কথায় ও আলোচনায় এ নিয়ে
সব পক্ষ ইতিবাচক থাকলেও বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। তিনি জানান, অন্য
দলগুলোর তুলনায় আওয়ামী লীগের কমিটিতে নারীর উপস্থিতি বেশি। প্রায় ২০
শতাংশের কাছাকাছি; কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ এবং মন্ত্রিসভা তাদের হতাশ
করেছে। আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় দল সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য
মাত্র ১৯ জন নারীকে মনোনয়ন দিয়েছিল। আর দলটির গঠন করা সরকারের মন্ত্রিসভায়
মাত্র ৩ জন নারী। এটাকে হতাশাজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুরুষতান্ত্রিক
মানসিকতাই এ জন্য দায়ী।
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭ সম্পর্কে জানতে চাইলে এ আইনভুক্ত বিশেষ বিধানের
ব্যাপারে ঘোর আপত্তি তোলেন দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এ নারী নেত্রী। তিনি
বলেন, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তার সময়েই মেয়েদের
বিয়ের বয়স ২২ বছর হওয়া উচিত বলে মনে করেছিলেন। অথচ এত বছর পরও মেয়েদের
বিয়ের বয়স ১৮ নির্ধারণ করে তার ভেতর আবার বিশেষ বিধান জুড়ে দেওয়া হয়।
পারিপার্শ্বিকতা বিশ্নেষণ করলে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, পরিবারে নারী
হওয়ার কারণেই তাদের নির্যাতিত হতে হয়।
রোকেয়া কবীর বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে অন্তত ১৫টি আইন-বিধি রয়েছে।
তারপরও সহিংসতা বন্ধ হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ আইনের কঠোর প্রয়োগ নেই। তা
ছাড়া সহিংসতার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনও জরুরি। তিনি বলেন, আমি একজন
মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭৫ সালের পর যখন বিভিন্ন দেশে যেতাম সেখানকার মানুষ প্রশ্ন
করত, তোমরা কেমন জাতি- নিজেদের নেতাকে নিজেরাই হত্যা কর? তখন লজ্জায় কথা
বলতে পারতাম না। আর এখন সবাই প্রশ্ন করে, যে দেশে প্রধানমন্ত্রী নারী,
স্পিকার নারী, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা নারী, সে দেশে এত নারী নির্যাতন হয়
কীভাবে। এ প্রশ্নেও লজ্জিত হই।
জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা, ১৯৯৭-এর কিছু জায়গায় পরিবর্তন করে ২০১১ সালে
জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা পুনর্গঠন করা হয়। রোকেয়া কবীর বলেন, জাতীয় নারী
উন্নয়ন নীতিমালা ১৯৯৭ সবার প্রশংসা পেয়েছিল। এ নীতিমালায় সম্পত্তিতে নারীর
সমান অধিকারের বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছিল। কিন্তু নানা কারণে এতে কিছু
পরিবর্তন এনে পুনর্গঠন করা হয়েছিল। অথচ দীর্ঘ আট বছরে সেই নীতিমালারও
পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ঘটেনি। এর একটি অন্যতম কারণ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক
মন্ত্রণালয় অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের তুলনায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল। এ কারণেই আমরা
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে একটি পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় করার দাবি
জানিয়ে আসছি।
সদ্য গঠিত সরকারের কাছে কোনো প্রত্যাশা রয়েছে কি-না, তা জানতে চাইলে
মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া কবীর বলেন, নিশ্চয়ই আছে। দীর্ঘদিনের এমন চাওয়ার মধ্যে
রয়েছে উত্তরাধিকারে নারীদের সমান অধিকার দেওয়া হোক। সেই সঙ্গে নারী উন্নয়ন
নীতি ২০০৩-০৪-এ সমানাধিকারের যে বিষয়গুলো অপসারণ করা হয়েছে, সেগুলো আবার
যোগ করা হোক। নারীবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে পূর্ণ মন্ত্রণালয় ঘোষণা করার পাশাপাশি
বাজেটে একটা সুর্নিদিষ্ট অংশ নারীর জন্য বরাদ্দ করা হোক। একটি জাতীয় নারী
কমিশন গঠনের দাবিও রয়েছে তার- যেটি নারীর প্রতি যে কোনো ধরনের বৈষম্যমূলক
আইন, নীতি এবং কার্যক্রম রাষ্ট্র কিংবা অন্য যেই করুক না কেন- তাদের মনিটর
করবে। তিনি বলেন, এ দেশের বিচার ব্যবস্থা, পুলিশি ব্যবস্থা বা নির্যাতনের
বিষয়গুলো যারা দেখেন, তারা সবাই কমবেশি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার। তারা মনে
করেন না, নারীর প্রতি সহিংসতা সাংঘাতিক ব্যাপার। এমনকি বিভিন্ন মামলার
আইনজীবীদের অনেকেরই দৃষ্টিভঙ্গি এমন। নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার জন্য
একটা কমিশন থাকলে তারা এসব ইস্যু সামনে আনতে পারবে।