ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

উচ্চ আদালতে বাংলা ব্যবহার

বিচারপতিদের আগ্রহ বাড়ছে

বিচারপতিদের আগ্রহ বাড়ছে

আবু সালেহ রনি

প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | ১৯:৫৮

উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষায় রায় ও আদেশ দেওয়ার বিষয়ে বিচারপতিদের আগ্রহ বাড়ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাইকোর্টের দু'জন বিচারপতি বাংলায় রায় ও আদেশ দিলেও গত বছর থেকে এর সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত ৯৯ জন বিচারপতির মধ্যে সাতজন কমবেশি বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়ে আলোচনায় রয়েছেন।

তারা হলেন বিচারপতি মো. আবু তারিক, বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ, বিচারপতি ড. কাজী রেজা-উল হক, বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন, বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম। তবে তাদের মধ্যে বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন সবচেয়ে বেশিসংখ্যক রায় ও আদেশ বাংলায় লিখে অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন। তিনি এ পর্যন্ত আট হাজারেরও বেশি রায় বাংলায় দিয়েছেন। এরপরেই আছেন বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল। অন্য পাঁচজন বিভিন্ন ক্ষেত্রে কমবেশি বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়েছেন।

সর্বক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ বাংলা ভাষা প্রচলন আইন প্রণয়ন করা হয়। সংবিধানেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশনা রয়েছে। তবে আজও উচ্চ আদালতে পূর্ণাঙ্গভাবে এই বিধান কার্যকর হয়নি। আদালতসহ সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে আট বছর আগে আইন কমিশন থেকেও সরকারকে সুপারিশ করা হয়েছিল।

আইনজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘ অপেক্ষার পর বাংলা রায় ও আদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিচারপতিদের আগ্রহ বাড়ছে; এটি অত্যন্ত ইতিবাচক। ভবিষ্যতে বাংলায় আরও বেশি রায় ও আদেশ পাওয়া যাবে বলে তারা প্রত্যাশা করেন। অনেকের মতে, ভাষাগত জটিলতা এবং বহির্বিশ্বের বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে উচ্চ আদালতের সব মামলার রায় বাংলায় দেওয়া বিচারপতিদের জন্য দুরূহ। তবে বিচারপতিরা রায় ও আদেশ দেওয়ার সময় বাংলাদেশ, মাতৃভাষা ও মুক্তিযুদ্ধের বিষয়গুলোতে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের উপযোগী মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দেবেন- এমনটাও প্রত্যাশা।

আলোচিত মামলার মধ্যে সর্বশেষ বাংলায় রায় দিয়েছেন বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল। গত ১ ফেব্রুয়ারি নদী দখল-সংক্রান্ত এক আলোচিত মামলায় রায় দেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। তবে এর মধ্যে বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল মূল রায়টি বাংলায় দিয়েছেন। তিনি ২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলায় হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চের তৃতীয় বিচারক হিসেবে শুরু করে এখন নিয়মিতভাবে বাংলায় রায় ও আদেশ লিখে আসছেন। এর সংখ্যা ইতিমধ্যে কয়েকশ' ছাড়িয়েছে।

অন্যদিকে বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই সব আদেশ ও রায় বাংলায় দিয়ে আসছেন। বাংলায় লেখা তার উল্লেখযোগ্য রায়ের মধ্যে রয়েছে বিজিএমইএ ভবন ভাঙা, এমভি নাছরিন-২ লঞ্চডুবি ঘটনায় ক্ষতিপূরণ ও সাজা, অর্থঋণ আদালত, হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের মামলা।

সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর ৯০ দশক থেকে উচ্চ আদালতে বাংলার ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়। প্রয়াত সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও বিচারপতি এম আমীরুল ইসলাম চৌধুরী বাংলায় কয়েকটি আদেশ ও রায় দিয়েছিলেন; কিন্তু তা আইন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়নি। ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত আইন সাময়িকীর (ঢাকা ল রিপোর্টস ৫০ ও ৫১ ডিএলআর) তথ্যানুসারে, ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ও বিচারপতি হামিদুল হক সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ নজরুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র মামলায় বাংলায় রায় দিয়েছিলেন। একই সময়ে বিচারপতি হামিদুল হক অন্য একটি ফৌজদারি রিভিশন মামলায়ও বাংলায় রায় দেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময় সাবেক বিচারপতি আবদুল কুদ্দুছ, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ বাংলায় বেশ কয়েকটি রায় দিয়েছেন।

তবে তাদের মধ্যে বাংলা ভাষায় রায় দিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। তিনি বিচারপতি হিসেবে হাইকোর্টে থাকার সময় মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত স্থানসহ স্থাপনা সংরক্ষণ, স্বাধীনতার ঘোষক, ঢাকার চার নদী রক্ষাসহ প্রায় দেড়শ' উল্লেখযোগ্য মামলার রায় বাংলায় দেন। বিচারপতি খায়রুল হক বর্তমানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলায় রায় ও আদেশ লেখা প্রসঙ্গে তিনি সমকালকে বলেন, অনেকেই বাংলা রায় ও আদেশ শুরু করেছেন। এমনটা হবে সেই ভরসাতেই বাংলায় রায় দেওয়া শুরু করেছিলাম। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বিষয়টি তো সংবিধানেই বলা আছে। এখন দেখা যাক আগামী দিনে কীভাবে এটি কার্যকর করা হয়।

প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, যিনি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্টে দায়িত্ব পালনকালে একাধিক উল্লেখযোগ্য রায় বাংলায় দিয়েছিলেন। বাংলায় রায় লেখা প্রসঙ্গে বিচারপতি মোহাম্মদ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলায় রায় দেওয়া সহজ বিষয় নয়। তবুও আশা করছি, আরও বেশিসংখ্যক বিচারপতি বাংলায় রায় ও আদেশ দেবেন। এতে অন্য বিচারপতিরাও উৎসাহী হবেন।

বাংলায় রায় ও আদেশ লেখা প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, হাইকোর্টের অনেক বিচারপতিই এখন বাংলায় রায় বা আদেশ দিচ্ছেন। এতে বোঝা যাচ্ছে বাংলায় রায় দিতে তারা আগ্রহবোধ করছেন। তবে বিচারকদের জন্য বাংলায় রায় দেওয়া 'কষ্টকর' মন্তব্য করে তিনি বলেন, আদালতে ব্যবহূত বিভিন্ন দেশের মামলার রায় এবং অন্যান্য রেফারেন্স সবই ইংরেজিতে। আইনজীবীরাও ইংরেজিতে নথি উপস্থাপন করেন। তবে বার (বিচারপতি) ও বেঞ্চ (আইনজীবী) চাইলে বাংলায় রায় দেওয়া সংশ্নিষ্টদের জন্য সহজতর হয়। এ ক্ষেত্রে উভয়পক্ষের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। বাংলায় রায় লেখার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের ভূমিকা প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র স্পেশাল অফিসার (অতিরিক্ত জেলা জজ) মো. সাইফুর রহমান বলেন, রায় ও আদেশ বাংলায় দিতে বিচারপতিদের কোনো আইনি বাধা নেই। তবে তারা ইংরেজি বা বাংলা কোন ভাষায় রায় দেবেন- সেটি তাদের নিজস্ব বিষয়।

এদিকে উচ্চ আদলতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বিষয়ে ২০১৬ সালে জাতীয় সংসদের স্পিকারের কাছেও আবেদন করেছিলেন হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ শফিকুর রহমান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, জনস্বার্থে বিষয়টিতে নজর দিতে স্পিকারের কাছে আবেদন করেছিলাম। তিনি পরে জানিয়েছিলেন, এ বিষয়ে সংসদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু সংসদ অধিবেশনে আলোচনা ছাড়া গত তিন বছরে বিষয়টি নিয়ে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। সংবিধান ও আইন অনুযায়ী উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষাকে প্রাধান্য দিলে সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের ইচ্ছা পূরণ হবে।

আরও পড়ুন

×