ভাষার বিকাশে যা করণীয়
বিশেষ লেখা
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | ১৯:৫৯
ভাষা নিয়ে আমাদের আবেগ অনেক, কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো চিন্তা নেই, যে
চিন্তা ভাষা-শিক্ষা, ভাষা ব্যবহার এবং ভাষার ক্রমাগত বিকাশে ভূমিকা রাখে।
পৃথিবীর নানা দেশে ভাষানীতি আছে- তাতে মাতৃভাষা শিক্ষা ও ব্যবহার নিয়ে অনেক
দিকনির্দেশনা থাকে, দ্বিতীয় ও বিদেশি ভাষা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা থাকে। ২০১০
সালে আমরা একটা শিক্ষানীতি গ্রহণ করেছি, তাতে ভাষানীতির প্রয়োজনীয়তার কথা
বলা আছে, কিন্তু শিক্ষানীতিরই যেখানে বাস্তবায়ন নেই, ভাষানীতি নিয়ে নড়াচড়ার
সম্ভাবনাটা তাহলে কতটা থাকে।
আমাদের জীবনের সৃজন ও মননশীল এলাকায় সরকারের নিয়মবিধির- বিশেষ করে যেগুলো
মানুষের ইচ্ছা বা প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়- পক্ষে আমি নই। আমি
বিশ্বাস করি, শিক্ষা ও ভাষা নিয়ে
আমাদের সমষ্টির চিন্তাটি দাপ্তরিক দিকনির্দেশনায় প্রতিফলিত হওয়া উচিত।
ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে আমাদের তরুণেরা রক্ত দিয়েছেন, ১৯৯৯ সাল থেকে
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পেয়েছে। কাজেই
মাতৃভাষা চর্চায় আমাদের সর্বোচ্চ বিনিয়োগ প্রয়োজন। এই বিনিয়োগের রূপ হচ্ছে
রাষ্ট্রের সদিচ্ছা থেকে নিয়ে সাংস্কৃতিক এবং আর্থিক। শিক্ষা নিয়ে আমাদের
সামষ্টিক স্বপ্ন আছে, প্রত্যাশা আছে। আমরা চাই, আমাদের সন্তানরা সুশিক্ষিত
হবে, আলোকিত মানুষ হবে। স্বাধীনতার পর ৪৮ বছর পার হয়ে গেছে, শিক্ষার প্রসার
ঘটেছে। এখন দেশে শিক্ষিতের হার ৭০ শতাংশের ঘরে। কিন্তু আমাদের সন্তানরা কি
সুশিক্ষিত হচ্ছে, নিজ নিজ ক্ষেত্রে সকলেই আলো ছড়াচ্ছে? আমাদের শিক্ষায়
মাতৃভাষা অবহেলিত, অনাবশ্যক কতগুলি পাবলিক পরীক্ষার চাপে শিক্ষার্থীরা কাতর
ও ক্রমাগত মুখস্থবিদ্যা চর্চা এবং জিপিএ ৫ পাওয়ার অর্থহীন প্রতিযোগিতা
তাদের মেধার ঘরে ঘাটতি জোগাচ্ছে। এই পাবলিক পরীক্ষাগুলির অসিলায়
গ্রাম-গঞ্জে পৌঁছে গেছে কোচিং বাণিজ্য। যে শিক্ষার্থী এখন বিশ্ববিদ্যালয়
পর্যায় শেষ করে বেরোচ্ছে, তার প্রধান চিন্তা সরকারি কর্মকর্তা হওয়া। তার
ভাষাজ্ঞান দুর্বল। ইংরেজির কথা বাদ দিলাম, বাংলাতেই তার সক্ষমতা
প্রশ্নবিদ্ধ। এটি কেন হবে?
আমার একটি বিশ্বাস হচ্ছে, যে শিক্ষার্থীকে তার মাতৃভাষায় কাঙ্ক্ষিত দখলটি
দিতে পারবে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি, সে অনায়াসে তার অনুরূপ দখল অন্য
ভাষাতেও দেখাতে পারবে। মুশকিল হচ্ছে, আমাদের এই সময়ের শিক্ষাচিন্তা, পেশার
জগৎ, সামাজিক লেনদেন, এমনকি সৃজনশীলতার নানা অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে পুঁজি এবং
বাজার। এবং বাজারই নির্ধারণ করে দিয়েছে, ইংরেজিই হচ্ছে বৈশ্বিক এবং দেশীয়
যোগাযোগের ও বাজারের প্রধান এবং একমাত্র ভাষা। এটি আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার
মতো এই উপমহাদেশেও ঘটছে। কিন্তু আমাদের ইংরেজিতে যথেষ্ট সক্ষমতা নেই,
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ইংরেজিতে কুশলতা দেখাতে পারছে না। এর একটা বড় কারণ,
আমাদের মাতৃভাষা শিক্ষাতে মৌলিক কিছু দুর্বলতা। এ জন্য আমরা না মাতৃভাষায়
সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জন করতে পারছি, না ইংরেজিতে। মাদ্রাসায় পড়ে যারা আরবি
শিখছে, তাদের কজন আরবিতে কথা বলতে পারেন?
এখন সময় এসেছে মাতৃভাষা চর্চার দিকে মনোনিবেশ করা এবং সর্বোচ্চ অভিনিবেশ
নিয়ে তা করা। আমি বললাম বটে- 'এখন সময় এসেছে', সময়টা আসার কথা ছিল ৪৮ বছর
আগেই। যেহেতু মনোনিবেশটা তখন দিতে পারিনি- সেই ইচ্ছা বা উদ্দেশ্যও আমাদের
ছিল না- তা এখনই দিতে হবে। আরও কয়েক বছর ঢিলেমি করে পার করে দিলে আমরা এতই
পিছিয়ে পড়ব যে, একেবারে গোড়া থেকে শুরু করার সময় আর তখন থাকবে না।
এ জন্য প্রথমেই ভাবতে হবে, মাতৃভাষা কারা শেখাবেন, কোথায় শেখাবেন, কীভাবে
শেখাবেন। আমরা জানি, মাতৃভাষা প্রথম শেখায় পরিবার, পরে বিদ্যালয়। পরিবার সব
সময় সক্ষম হয় না; কিন্তু বিদ্যালয়গুলিতে সক্ষমতা থাকতেই হবে। ভালো শিক্ষকই
পারেন ভালো শিক্ষা দিতে। কিন্তু ভালো শিক্ষক তৈরির জন্য, তাদের নিয়োগ
দেওয়ার জন্য আর্থিক বরাদ্দের প্রয়োজন। সেই বরাদ্দ বাড়াতে আমাদের শিক্ষা
বাজেটকে জিডিপির অন্তত চার শতাংশে পৌঁছাতে হবে। শিক্ষকদের বেতন-ভাতার
পাশাপাশি বিদ্যালয়ের অবকাঠামো, গ্রন্থাগার ইত্যাদিও বাড়াতে হবে। মাতৃভাষা
শিক্ষার উৎকর্ষ অর্জনের জন্য শিক্ষার সার্বিক মানও বাড়াতে হবে। সে জন্য এই
বরাদ্দের প্রয়োজন।
কীভাবে শেখাতে হবে মাতৃভাষা- এটি পদ্ধতির এবং কৌশলের প্রশ্ন। এ জন্যই
শিক্ষানীতি প্রয়োজন। আমাদের দেশে ভাষাবিজ্ঞানী এবং ভাষাচিন্তাবিদদের অভাব
নেই। তাদের পরামর্শ ও সহযোগিতা নিয়ে নীতিটি করে ফেলা যায়। তখন হয়তো দেখা
যাবে- নতুন পাঠক্রমে, নতুন বিন্যাসে এবং কার্যকারিতার সঙ্গে শিক্ষার্থীরা
একেবারে গোড়া থেকেই মাতৃভাষা শিখছে। শিক্ষানীতিই নির্দেশ করে দেবে কখন এবং
কীভাবে ইংরেজি শেখা শুরু করা যায়। শিক্ষানীতি ভাষা ব্যবহারের অন্যান্য
ক্ষেত্রেও উৎকর্ষের নির্দেশনা দেবে। সরকারি দপ্তরে, আদালতে (এবং উচ্চ
আদালতে), করপোরেট বিশ্বে এবং মিডিয়ায় মাতৃভাষা ব্যবহারে যে দুর্বলতা,
অরাজকতা এবং অনুপস্থিতি রয়েছে, তখন হয়তো তা থাকবে না।
২. তবে সকলের আগে প্রয়োজন আমাদের নিজেদের ঐকান্তিকতা ও নিষ্ঠা। আমরা যদি
বুঝি যে, মাতৃভাষা ব্যবহারে আমাদের প্রচুর দুর্বলতা আছে এবং সেগুলি শোধরানো
দরকার, তাহলেই না আমরা সক্রিয় হবো। আমরা যদি স্বীকার করি, 'আসলে' ও
'কিন্তু' ধরনের ঠেকা-শব্দ এবং অকারণ ইংরেজি শব্দের ব্যবহার ছাড়া আমরা একটা
বাক্যও ঠিকমতো বলতে পারি না; তাহলেই না আমরা সচল হবো।
সক্রিয় এবং সচল আমাদের হতেই হবে; ভাষা ব্যবহারে আরও উন্নতি এবং উৎকর্ষের
জন্য, উন্নত শিক্ষার জন্য ভাষা-শিক্ষায় বিনিয়োগ এবং সর্বোচ্চ অর্জনের জন্য।
বিশ্বে আমরা অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছি; এখন প্রয়োজন আমাদের
সাংস্কৃতিক শক্তির পুনর্জাগরণ। ভাষা দিয়ে এটি সম্ভব। যদি শতভাগ মানুষ
শিক্ষিত হয়, যদি ভাষা ব্যবহারে তারা সর্বোচ্চ সক্ষমতা অর্জন করে, যদি
আঞ্চলিক ভাষাগুলি শক্তিশালী হয়, যদি আদিবাসীদের মাতৃভাষা সুরক্ষিত এবং
চর্চিত হয়, তাহলে পুনর্জাগরণের শক্তি আমাদের অর্জিত হবে।
- বিষয় :
- বিশেষ লেখা