ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের কথা
বঙ্গবন্ধুর পথেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশ
মুস্তাফিজ শফি
আমরা শোকাহত, কিন্তু শক্তিহীন নই। আমাদের চোখ অশ্রুসিক্ত, কিন্তু চোখের
কোণে প্রতিফলিত হয় প্রত্যয়ের আগুন। বছর ঘুরে আসা ১৫ আগস্ট আমাদের জন্য কেবল
বেদনার তারিখ নয়, অন্তর্গত বিক্ষোভে অযুত হৃদয়ে জ্বলে উঠবারও দিন। জাতির
পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের মর্মন্তুদ
হত্যাকাণ্ড বাঙালি জাতিকে মুহূর্তের জন্য হয়তো সেদিন বিহ্বল করেছিল, কিন্তু
সেই শোককে শক্তিতে রূপান্তর করতে খুব বেশি সময় লাগেনি। বাংলাদেশ ঘুরে
দাঁড়িয়েছে- বঙ্গবন্ধুকে নিয়েই, বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ ধরেই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার 'জীবনস্মৃতি' গ্রন্থে বলেছেন- 'যে ক্ষতি পূরণ হইবে
না, যে বিচ্ছেদের প্রতিকার নাই, তাহাকে ভুলিবার শক্তি প্রাণশক্তির একটি
প্রধান অঙ্গ।' প্রায় সাড়ে চার দশক আগে বাংলাদেশের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিল,
তা পূরণ করার চেষ্টাও আমাদের দিয়েছে প্রাণশক্তি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের
সোনার বাংলা গড়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। আমাদের বুকের গভীরে তারই অবিনাশী
উচ্চারণ- 'কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।'
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক
ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক মুক্তির সুমহান আদর্শগুলো ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল।
বাংলাদেশ যাত্রা করেছিল পেছনের দিকে, অন্ধকারের অভিমুখে। একাত্তরে মহান
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত যে মুক্তির আলো আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে
দিয়েছিল ঠিক তার উল্টো পথে। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গের হত্যাকাণ্ডের
বিচার করা যাবে না- এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সংবিধানে যুক্ত করা
হয়েছিল সেই বর্বরোচিত দায়মুক্তি বা কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। সংবিধানে
যখন এমন বিচারহীনতার ধারা থাকে, গোটা দেশ তখন অবিচারে নিমজ্জিত না হয়ে
পারে? একের পর এক পুনর্বাসিত হচ্ছিল যুদ্ধাপরাধী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা। আর
এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সময় লেগেছিল দীর্ঘ একুশ বছর। রক্ত ঝরেছিল।
খালি হয়েছিল অনেক মায়ের বুক।
বঙ্গবন্ধুকন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চার মেয়াদের নেতৃত্বে
পশ্চাৎমুখী যাত্রা কেবল রুদ্ধ হয়নি, বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির
পথে। কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্রের বিচার
সম্ভব হয়েছে। সম্ভব হয়েছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও। বাংলাদেশে এখন
আর বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে না। তবে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের অন্তত ছয়জন এখনও
ফাঁসির দণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে ফেরার। এবার জাতীয় শোক দিবসে তাই আমাদের
প্রত্যয়- বিদেশ থেকে ফিরিয়ে এনে পঁচাত্তরের বাকি খুনিদের দণ্ডাদেশও কার্যকর
হবে। বঙ্গবন্ধুর পথে ঘুরে দাঁড়ানো বাংলাদেশের পক্ষে এ কোনো কঠিন বিষয় নয়,
শুধু শক্ত এবং দৃঢ় করতে হবে কূটনৈতিক যোগাযোগ।
কেবল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য নয়, পঁচাত্তরের কলঙ্কতিলক মোচন
করতে হবে আমাদের সামষ্টিক স্বার্থেই। যে জাতি ভাষার জন্য রক্ত দিতে পারে,
যে জাতি স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে পারে; নিজের পিতা হত্যার কলঙ্ক সে
জাতির জন্য চরম অবমাননাকর। এই কলঙ্ক থেকে আমাদের পুরোপুরি মুক্তি পেতেই
হবে।
আমরা মনে করি, বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাস, কূটনৈতিক মিশন বঙ্গবন্ধুর পলাতক
খুনিদের ফিরিয়ে আনতে সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করবে। বেসরকারি
সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোরও উচিত খুনিদের কুকর্ম তুলে ধরে দেশে দেশে
জনমত তৈরি করা। বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে
আদর্শিক দূরত্ব থাকলেও আইনের শাসনের স্বার্থে সব রাজনৈতিক দলেরও উচিত
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে আনতে নিজ নিজ পরিসরে সক্রিয় হওয়া। জাতিসংঘসহ
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও নিষ্ফ্ক্রিয় থাকবে কেন? দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধকালের হত্যাকারীদের যদি এখনও খুঁজে খুঁজে আইনের হাতে সোপর্দ করা
হয়, তবে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের কেন নয়?
প্রসঙ্গত, এখন সময় হয়েছে বঙ্গবন্ধুবিরোধী রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলোর
আত্মোপলব্ধির। পঁচাত্তরের খুনিচক্র পরবর্তী সরকারগুলোর কাছ থেকে যে সুবিধা
পেয়েছে, তা সভ্য সমাজে অকল্পনীয়। এও আজ বেদনার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময় জাগায়
যে, বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে তার খুনি ও মদদদাতারা রাজনৈতিক দল গঠন
করেছে এবং প্রশ্নবিদ্ধ কায়দায় ক্ষমতাও দখল করেছে! প্রকৃতির নির্মম
প্রতিশোধে সেসব রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী আজ বিপর্যস্ত। অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য
আত্মসমালোচনা তাদের নতুন রাজনৈতিক দিশা দেখালেও দেখাতে পারে।
বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ থেমে নেই। তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে
এগিয়ে চলছে। বঙ্গবন্ধু সেই বাহাত্তর সালেই বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে
নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করতেন বারংবার। বিলম্বে হলেও সেই যাত্রা সূচিত
হয়েছে। আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তকমা ঝেড়ে ফেলতে পারছি। আমরা নিম্ন আয়ের দেশ
থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণাধীন পদ্মা
সেতু প্রকল্প প্রমত্তা নদীর বুকে সগর্বে মাথা তুলে ঘোষণা করছে বাংলাদেশের
অর্থনৈতিক সামর্থ্য।
বাংলাদেশকে 'প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড' হিসেবে গড়তে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পরস্পরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ উস্কে
দেওয়ার আত্মঘাতী সংস্কৃতির বিপরীতে শান্তি ও স্থিতিশীলতার পক্ষে দৃঢ়
অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ। সদ্যমুক্ত স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে বঙ্গবন্ধু
কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাঙালি শরণার্থীদের কষ্টের কথা বলেছিলেন। লাখ লাখ
রোহিঙ্গা শরণার্থীকে নিঃশর্ত আশ্রয়, খাদ্য ও নিরাপত্তা দিয়ে বাংলাদেশ যেন
বঙ্গবন্ধুর সেই বেদনারই উপশম করতে চেয়েছে। মানবতার এমন নিদর্শন যে জাতি
দেখায়, তার জনকের খুনিদের কয়েকজন কেন অধরা থাকবে? আমরা কি এদের বিরুদ্ধে
বিশ্ব বিবেক জাগাতে পারব না।
সামাজিক সূচক, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কূটনৈতিক সাফল্যে বাংলাদেশ যখন সুবর্ণ
সময় অতিবাহিত করছে, তখন পনেরো আগস্টের মর্মন্তুদ অঘটন প্রতিবছর আমাদের জন্য
বেদনার বলিরেখা যোগ করে। আর কত অপেক্ষা করব আমরা জাতির পিতার সব খুনির
দণ্ডাদেশ কার্যকরের জন্য।
বাংলাদেশ জেগে আছে অশ্রুসিক্ত চোখে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রমাণ
করবে, শোক কীভাবে শক্তিতে পরিণত হয়। শারীরিকভাবে অনুপস্থিতি সত্ত্বেও
বঙ্গবন্ধু প্রতিদিনই আমাদের সেই শিক্ষা দেন। তার অনির্বাণ জীবন ও কর্ম এই
দেশ ও জাতির অনিঃশেষ প্রেরণার উৎস। আমাদের বারবার সেখানেই ফিরে যেতে হবে।
বুকে ধারণ করতে হবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। তিনি কিন্তু একদিনে বঙ্গবন্ধু বা
জাতির পিতা হননি। নিজেকে গড়ে তুলেছেন তিলে তিলে। খেটে খাওয়া গরিব সাধারণ
মানুষের জন্য রাজনীতি করেছেন আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে। মানুষের
প্রতি ভালোবাসাই তাকে অসাধারণ করে তুলেছে। বানিয়েছে মহানায়ক। সরল,
সোজাসাপটা বাক্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য রাজনৈতিক দর্শন।
তিনি বলেছিলেন, 'বিশ্ব আজ দুই শিবিরে বিভক্ত- শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের
পক্ষে।' বঙ্গবন্ধু আর বলেছিলেন, 'এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি
বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি
বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের
মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি বা কাজ না পায়।'
জীবনব্যাপী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে একটি শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক
সমাজেরই স্বপ্ন দেখেছেন বঙ্গবন্ধু। সেটাকে ধারণ করেই তার নির্দেশনায় ১৯৭২
সালে রচিত বাংলাদেশের সংবিধানে সংযোজিত হয়েছে চার মূলনীতি- বাঙালি
জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। একাধিক ঘনিষ্ঠজনের
লেখা ও সাক্ষাৎকারের তথ্য অনুযায়ী এই চার মূল নীতির মধ্যে বঙ্গবন্ধু নিজে
গুরুত্ব দিয়েছেন সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতায়। এখানেও তার একটি উক্তি
প্রণিধানযোগ্য, 'ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তার ধর্মকর্ম
করবে। হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাধা
দিতে পারবে না। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে
না।'
সময় এসেছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এই নীতিগুলোকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরার। আমরা
জানি, এদেশে অনেক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। আবার একই সঙ্গে বেড়েছে বৈষম্যও।
আর সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পতো রয়েছেই। এসব দিকে নজরদারি বাড়িয়েই আমাদের
প্রতিষ্ঠা করতে হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।