তিন বছর আগে পাকিস্তান থেকে ছয় মাসের পর্যটন ভিসায় বাংলাদেশে এসেছিলেন আমান খান (ছদ্মনাম)। পর্যটন ভিসায় এলেও ওই সময় একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি শুরু করেন তিনি। এরপর তার ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও আর দেশে ফিরে যাননি তিনি। ভিসা ছাড়া অবৈধভাবে অবস্থান করে বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করে যাচ্ছেন ওই পাকিস্তানি।

শুধু এ পাকিস্তানিই নন, ভিসা মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থান করছেন বেশ কয়েক হাজার বিদেশি। এদের মধ্যে প্রায় ১৬টি দেশের নাগরিক রয়েছেন। তবে এসব বিদেশি কখন, কীভাবে, কী উদ্দেশ্যে এ দেশে ঢুকছে, তার সঠিক তথ্য নেই সরকারের কাছে। এদের সঠিক সংখ্যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্নিষ্ট শাখার কোনো কর্মকর্তারও জানা নেই। তবে অবৈধভাবে অবস্থান করা বিদেশি নাগরিকদের ভিসার মেয়াদ বাড়ানো-সংক্রান্ত অসংখ্য আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের ইমিগ্রেশন শাখায় জমা পড়েছে। আবেদনে তথ্য গরমিল থাকায় অনেকটা সমস্যায় পড়েছেন কর্মকর্তারা।

এসব বিষয় মাথায় নিয়ে শেষ পর্যন্ত নড়েচড়ে বসছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। অবৈধভাবে অবস্থান করা বিদেশিদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। এসব বিদেশির সঠিক পরিসংখ্যান ও তাদের সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে অবস্থান করা বিদেশি নাগরিকদের অনেকের পাসপোর্টসহ কোনো কাগজপত্রই বৈধ নেই। এর পরও তারা গোপনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে যাচ্ছেন। সরকারকে কোনো ভ্যাট বা কর দেন না তারা। অথচ এ দেশের নাগরিকের চেয়েও তারা বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ তারা নিজ দেশে পাঠাচ্ছেন।

এসব তথ্য উল্লেখ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বেশ কয়েকবার অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ ছাড়া বিদেশি নাগরিকদের আর্থিক লেনদেন ও জঙ্গি অর্থায়নের বিষয় সূক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে একটি বিশেষ টিম গঠন করা হয়। বাংলাদেশে ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া অবস্থান করা বিদেশি নাগরিকদের কার্যক্রম, তাদের ভ্যাট ও ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার বিষয়ে ওই টিম কাজ করেছিল। টিমের অনুসন্ধারে বেরিয়ে আসে- বাংলাদেশে অবস্থানকারী প্রায় ১৫ হাজার বিদেশির ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। যাদের বেশিরভাগই পর্যটন ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তবে এটি সঠিক পরিসংখ্যান নয়, সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।

জানা গেছে, বিদেশিরা পর্যটন ভিসায় বাংলাদেশে এসে কখনো নিজের পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে, আবার কখনো ভিসার মেয়াদ থাকা অবস্থায়ই নানা 'অপতৎপরতা' চালায়। তারা রাজধানীর অভিজাত এলাকায় অবস্থান করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। তারা রাজধানীর গুলশান, বনানী, উত্তরার মতো অভিজাত এলাকাগুলোতে থাকছেন। তারা বিনিয়োগকারী পরিচয়ে অভিজাত হোটেলে উঠে বিদেশে লোক পাঠানো, বাংলাদেশে নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলার আশ্বাস ও চাকরির প্রলোভন দেখিয়েও সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। শুধু তাই নয়, এসব বিদেশি নাগরিক অস্ত্র, স্বর্ণ ও মাদক চোরাচালান, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, বিভিন্ন দেশের জাল নোট তৈরি, ডলার জালিয়াতি, এমনকি জঙ্গি তৎপরতায়ও নিজেদের জড়াচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তান, লিবিয়া, চীন, নাইজেরিয়া, ভারতসহ কমপক্ষে ১৬টি দেশের কয়েক হাজার নাগরিক অবৈধভাবে অবস্থানের পাশাপাশি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত বলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রমাণ পেয়েছে।

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার প্রেক্ষাপটে ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ বিদেশি নাগরিকদের বিষয়ে সরকার গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করছে। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য এলাকায় বিদেশিদের আবাসস্থল ও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত যাচাই করা হচ্ছে। তবে তথ্য সঠিক না থাকলে ঢাকায় তাদের দূতাবাসের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের বিষয় নিয়েও পর্যালোচনা করা হবে। এরপর দূতাবাসগুলো পদক্ষেপ না নিলে গোয়েন্দা সংস্থার সুপারিশ আমলে নিয়ে অবৈধ বসবাসকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে সরকার।

সৌদি আরব, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বিদেশিদের ওপর কড়া নজরদারি থাকলেও বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগ কখনোই নেওয়া হয়নি। শুধু ঘটনাক্রমে কোনো বিদেশি আটক হলেই তখনই নড়েচড়ে বসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, 'ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ বিদেশি যেসব নাগরিক বাংলাদেশে অবস্থান করছেন, তাদের অনেকেই ফের ভিসার জন্য আবেদন করেছেন। এসব আবেদন যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে অনুমোদন দেওয়া হবে। তবে কেউ যাতে সমাজবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড না চালাতে পারে, সেজন্য তাদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে। তারা যেন কোনো অপরাধমূলক কাজেও জড়াতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক রয়েছে সরকার। যাদের বিরুদ্ধে অপরাধের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।'

এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কতজন বিদেশি বাংলাদেশে অবস্থান করছেন, তার পরিসংখ্যানে হয়তো গরমিল থাকতে পারে। তবে এখন সেটি সঠিকভাবে সংরক্ষণের জন্য আধুনিক ডাটাবেজ প্রস্তুত করা হচ্ছে। কারা কখন দেশে ঢুকছেন বা বের হচ্ছেন সে তথ্য ডাটাবেজে সংরক্ষণ থাকবে। তখন অবৈধভাবে অবস্থান করার সুযোগ থাকবে না।