সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের উমেদপুর গ্রামে ২৫০ একরের বিশাল জলাশয় বাঁধ দিয়ে ঘিরে রেখেছেন দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীনুর আলম। দেবোত্তর সম্পত্তির নামে জলমহালটি ইজারা দেওয়া হলেও পরে তিনি তা আড়াই লাখ টাকায় ভোগদখল করছেন।

সুমামগঞ্জসহ বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চলের জলমহালগুলো এভাবেই মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির ব্যানারে প্রভাবশালীরা দখলে নিয়ে জেলেদের মাছ ধরার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছেন। ইজারা দেওয়া জলমহালের সীমানা যথাযথভাবে চিহ্নিত না হওয়ায় জেলেরা তাদের বাড়ির সামনেও জাল ফেলতে পারেন না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রভাবশালীদের কাছে জলমহাল ইজারা দেওয়া বন্ধ হলে স্থানীয় জেলেরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারেন।

মৎস্যজীবী না হয়েও এত বড় বিল কীভাবে ভোগ করছেন জানতে চাইলে শাহীনুর বলেন, 'আমি তো এটা টাকার বিনিময়ে নিয়েছি। ৪০-৫০ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করব। এ বিলের মাছ প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতাসহ অনেকের কাছে যায়।'

বিল রক্ষায় অনেক কষ্ট করতে হয় দাবি করে শাহীনুর বলেন, 'রাত-দিন পাহারা দিতে হয়। তার পরও মাঝে মাঝে স্থানীয় জেলেরা বিলে ঢুকে পড়ে, তাই চাপ প্রয়োগ করতে হয়।'

মাছ ধরতে গেলেই রক্ত ঝরে জেলেদের : তাহিরপুর সদর উপজেলার পাশেই শনির হাওর দখল করে রেখেছেন সুনামগঞ্জের ব্যবসায়ী জিয়াউল হক। জলমহালটি দেখাশোনা করেন তাহিরপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বোরহান উদ্দিন। জেলে রঞ্জিত চন্দ্র দাস, আমিনুল ইসলাম ও বজলুর রহমান বলেন, শনির হাওরে মাছ ধরতে গেলেই জেলেদের ধরে নিয়ে যায় ব্যবসায়ী জিয়াউল হকের লোকেরা। মাছ ধরতে গিয়ে অনেকে হামলার শিকার হয়েছেন। কেউ কেউ মিথ্যা মামলায় জেলও খেটেছেন।

এ বিষয়ে তাহিরপুরের চেয়ারম্যান বোরহান উদ্দিন বলেন, শনির হাওর জামালগড় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে ইজারা নেওয়া। তিনি তাদের কাছ থেকে নিয়ে পরিচালনা করছেন। এটি পরিচালনার জন্য ব্যবসায়ী জিয়াউল হক কিছু টাকা দিয়েছেন। জেলেদের মাছ ধরতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, 'আমি নিজে জলমহালের সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছি। সীমানায় পাহারাদার আছে। সীমানার বাইরে গরিব জেলেদের মাছ ধরতে আমি সহায়তা করি। কোনো জেলের ওপর হামলা হয়নি।'

জামালগড় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক সজল বর্মন বলেন, শনির হাওরের এক হাজার একর জলমহাল ছয় বছরের উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায়



সরকার থেকে ইজারা নেওয়া। জলমহাল পরিচালনার জন্য ব্যবসায়ী জিয়াউল হক তাদের দুই কোটি টাকা দিয়েছেন। বিনিময়ে মাছ ধরে তাকে নির্ধারিত মূল্যে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, 'আমরা নিরীহ হিন্দু মানুষ। ফলে চেয়ারম্যান বোরহান উদ্দিনকে লাভের কিছু অংশ দিয়ে থাকি। তিনি সব সময় আমাদের সহায়তা করেন।' এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে জিয়াউল হককে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি সাড়া দেননি।

শনির হাওরের মতোই সিলেট বিভাগে আড়াই হাজার ছোট-বড় জলমহাল নিয়ন্ত্রণে রয়েছে প্রভাবশালীদের লাঠিয়াল বাহিনী। ইতিপূর্বে মাছ ধরতে গিয়ে ইজারাদারদের গুলিতে অনেক জেলে জীবনও দিয়েছেন।

তাহিরপুরের মাছ বাজারে কথা হয় জেলে লিটন দাসের সঙ্গে। তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, 'সগল (সকল) জায়গা তো অখন মানুষরূপী বোয়ালদের ফেটে (পেটে)। মাছ মাইরা আর সংসার চালাইবার উফায় (উপায়) নাই। না খাইয়া মরতে অইবো।' তিনি বলেন, প্রভাবশালীদের পাহারাদারেরা বলে পানি যতদূর, বিলের সীমানাও তত দূর। এতে জেলেরা মাছ ধরার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।

সরকারি দলের নেতাদের দখলেই অধিকাংশ জলমহাল :জানা গেছে, হাওরের জলমহাল দখলের তালিকায় রাজনৈতিক নেতাদের সংখ্যাই বেশি। উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় জগন্নাথপুরের বড় জলমহাল গাধিয়ালা ৩৬ লাখ টাকায় ইজারা নেয় সমদল মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি। এটি শাসন করেন জগন্নাথপুর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন ভূঁইয়া, উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি আফছার উদ্দিনসহ প্রভাবশালীরা। এভাবে ধর্মপাশার সুনই নদী ২০ লাখ টাকায় ইজারা নেয় সুনই মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি। তবে এটি ভোগ করছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের ভাই ধর্মপাশা উপজেলা যুবলীগের সভাপতি মোজাম্মেল হোসেন রুকনসহ প্রভাবশালীরা। তবে সংসদ সদস্য রতন সমকালকে বলেন, 'আমার চৌদ্দগুষ্টির কেউ মাছের ব্যবসা করে না। জলমহাল ইজারা এবং দেখাশোনার দায়িত্ব সরকারের। অনিয়ম হলেও ব্যবস্থা নেবে সরকার।'

দিরাইয়ের রফিনগর ইউনিয়নের চিকনদাইড় জলমহালটি অবৈধ দখলদারের অধীনে রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ধর্মপাশার তাড়ল ইউনিয়নের শয়তানখালী জলমহাল নিয়ন্ত্রণ করছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ বিলকিস। তিনি বলেন, বিলটি ইজারা নিয়েছে হাওর কথা মৎসজীবী সমবায় সমিতি। তিনি চার বছর এটি পরিচালনা করেছেন। বর্তমান এটি সমিতিই পরিচালনা করে।' হান্দুয়া সান্দুয়া জলমহালটি ইজারা না নিয়ে ছয় বছর ধরে লুটেপুটে খাচ্ছে একটি প্রভাবশালী মহল। এতে জেলা প্রশাসন প্রতি বছর অন্তত ২৫ লাখ টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে, দিরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ রায়, সহসভাপতি অ্যাডভোকেট সোহেল আহমদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র মোশারফ মিয়া দিরাইয়ের প্রায় দশটি জলমহাল নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাহিরপুরের মাটিয়ান হাওর ভোগ করছেন তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইকবাল হোসেন, একই উপজেলার শিববাড়ি হাওর যুবলীগ নেতা ও দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী। মধ্যনগরের হানিয়া, ধারাম ও কলমা হাওর দখল করে রেখেছেন ধর্মপাশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আলমগীর কবির। জামালগঞ্জের ছাতিধরা ভোগ করছেন বিএনপি নেতা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শামসুল আলম ঝুনু মিয়া। ডুবাইল হাওর দখল করে আছেন ধর্মপাশা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ মুরাদ।

এ ছাড়া বাইনচাপড়া জলমহাল দখল করে আছেন মধ্যনগর থানা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মোবারক হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা জহিরুল ইসলাম মাস্টার ও আলমগীর কবির। রূপেস্বর জলমহাল ভোগ করছেন আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন। গোড়াডোবা জলমহাল নিয়ন্ত্রণ করছেন মধ্যনগর থানা যুবলীগের সভাপতি মোস্তাক আহমেদ।

অধিকাংশ দখলদারের দাবি, তারা কোনো অন্যায় করেননি। প্রকৃত ইজারাদারের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে জলমহাল কিনে নিয়েছেন। তবে রুহুল আমিন নিজেকে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক পরিচয় দিয়ে বলেন, মধ্যনগর আশেকান মৎস্যজীবী সমিতির নামে ইজারা নেওয়া রূপেস্বর জলমহাল ১৭ লাখ টাকায় নিয়েছিলাম। দুই বছর আগে মোকছেদ, এমপি রতনের সাবেক পিএস শামীম আহমেদ মুরাদ, আনোয়ার হোসেন সাগর, নাজিম, নবাব আলী ও পরিতোষ সরকার সেটি দখল করে নেয়। এমপি মীমাংসা করে দেওয়ার পরও কাজ হয়নি। তাদের যন্ত্রণায় দুই বছর আগে জলমহাল ছেড়ে দিয়েছেন। বর্তমানে এটি আরিফপুর মৎস্যজীবী সমিতির নামে ইজারা নেওয়া। তবে সমিতির সভাপতি আব্দুল আজিজ দখল না পেয়ে পথে পথে ঘুরছেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, 'দল ক্ষমতায় অথচ নিজের জমি বিক্রি করে খাচ্ছি।'

নীতিমালা মানা হচ্ছে না :জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালায় মৎস্যজীবী ছাড়া কাউকে জলমহাল ইজারা না দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। এ ছাড়া ইজারা দেওয়া জলমহাল হস্তান্তর না করার বিধান থাকলেও তা লঙ্ঘিত হচ্ছে। বাস্তবে অ-মৎস্যজীবীরাই জলমহাল দখলে রেখেছেন। প্রকৃত মৎস্যজীবীদের সমিতির নামে ইজারা দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত স্থানীয় প্রভাবশালীরাই ভোগ করছেন জলাভূমি। আবার অনেক সময় ভুঁইফোঁড় মৎস্যজীবী সমিতির নামে যে সংগঠন দেখানো হচ্ছে, সেখানে কোনো মৎস্যজীবীই নেই। জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটিতে স্থানীয় সাংসদকে উপদেষ্টা রাখায় তার উপদেশে অনেক কলকাঠি নড়ে। জেলেরা এই নিয়ম বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, সরকারি আইন ও নিয়ম মেনে প্রকৃত মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিকে জলমহালগুলো ইজারা দেওয়া হয়। ভাসান পানি বা উন্মুক্ত জলাশয়ে জেলেদের অবাধ অধিকার রয়েছে। মাছ ধরতে প্রভাবশালীদের বাধার লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।