ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ
ব্যর্থতার পর অক্টোবরের দিকে তাকিয়ে দুই সিটি

অমিতোষ পাল
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অক্টোবর মাসের দিকে তাকিয়ে আছে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন। তারা মনে করছে, চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ের পর থেকেই ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতে শুরু করবে। অক্টোবরে গিয়ে বৃষ্টিপাতের মাত্রা আরও কমে যাবে। বৃষ্টিপাত কমে গেলেই ডেঙ্গু রোগের জীবাণুবাহী এডিস মশার বংশবিস্তার উপযোগী পরিবেশও কমবে। তখনই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
এর আগ পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে চলমান কার্যক্রমের মতো নৈমিত্তিক কার্যক্রম চলতে থাকবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. ইন্দ্রানী ধর সমকালকে বলেন, চলতি সেপ্টেম্বরেই ডেঙ্গু কিছুটা কমে আসবে। অক্টোবরে আরও কমে যাবে। এটা প্রাকৃতিকভাবেই হয়। সিটি করপোরেশনও হয়তো সেই অপেক্ষায় আছে। এরপর তারা বলতে শুরু করবে তাদের তৎপরতার কারণে ডেঙ্গু কমেছে। কিন্তু এবার ডেঙ্গুর ভয়াবহ আকার ধারণের পেছনের কারণ হলো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যেভাবে নিবিড় পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন ছিল, সিটি করপোরেশন সেটা করতে পারেনি। এখন সেপ্টেম্বর মাস পার করাটাই সিটি করপোরেশনের জন্য চ্যালেঞ্জ।
বিশেষজ্ঞরা জানান, স্মরণকালের মধ্যে ২০০১-০২ সালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সবচেয়ে নিয়ন্ত্রণে ছিল। এর কারণ হিসেবে তারা জানান, ওই সময় কীটতত্ত্ববিদদের দিয়ে একটি মনিটরিং টিম গঠন করেছিল অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন। তখন নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পরিকল্পনা করে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। মার্চের শুরুতেই যখন কোথাও ডেঙ্গু রোগীর সন্ধান মেলে, তখনই ওই রোগীর অবস্থানের ৪০০ মিটার দূরত্বের সর্বত্র মশকবিরোধী অভিযান চালানো হয়। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে মনিটরিং কার্যক্রম চলে। হটস্পটগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এ কারণে ওই দুটি বছরে এডিস মশার তেমন দৌরাত্ম্য চোখে পড়েনি। পরবর্তী সময়ে ওই কার্যক্রমের আর ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি সিটি করপোরেশন, যে কারণে চলতি বছরে গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত রাজধানীসহ সারা দেশে মারা গেছেন ৫৯৭ জন। আক্রান্ত হয়েছেন সোয়া লাখ। গতকাল শনিবার এক দিনে রেকর্ডসংখ্যক ২১ জন মারা গেছেন, যা কখনও হয়নি। আর গতকাল পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৬১৮ জনের। আক্রান্ত প্রায় ১ লাখ ২৯ হাজার।
তবে সিটি করপোরেশনে প্রয়োজনীয় কোনো কীটতত্ত্ববিদ নেই। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে একজন কীটতত্ত্ববিদের পদ থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে সেটি খালি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে সম্প্রতি একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের একজন অধ্যাপককে মেয়রের মশকবিষয়ক উপদেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু স্থায়ী জনবল হিসেবে যে রকম একটা পূর্ণাঙ্গ প্যানেল থাকা প্রয়োজন, সেটা নেই।
ডিএনসিসি মেয়রের মশকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. কবিরুল বাশার সমকালকে বলেন, এত দিন তো ধারণা ছিল সেপ্টেম্বর থেকে এডিস মশা কমতে থাকে। এটা নির্ভর করে বৃষ্টিপাতের মাত্রা কমার ওপর। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যদি সেপ্টেম্বরে বৃষ্টি না কমে, তাহলে ডেঙ্গু কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। আর অক্টোবরে বৃষ্টিপাতের মাত্রা কমাটা স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে অক্টোবরে গিয়ে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কমার বড় সম্ভাবনা রয়েছে। যদি বৃষ্টিপাত হতেই থাকে, তাহলে অক্টোবরেও ডেঙ্গু কমবে না। অবশ্য অক্টোবরে বৃষ্টি কমাই স্বাভাবিক।
মশক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দুই সিটি করপোরেশনের মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে একটি ছাতার নিচে আনার প্রয়োজনীয়তা সরকার বা সিটি করপোরেশন কখনও অনুভব করেনি। এই মুহূর্তে এটা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে আরেকটি স্বতন্ত্র মশক নিয়ন্ত্রণ দপ্তর করা যেতে পারে।
জানা যায়, ১৯৯০ সালের আগে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি থাকার সময় ঢাকা শহরের মশক নিয়ন্ত্রণের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তর নামে একটি দপ্তর ছিল। ঢাকা সিটি করপোরেশন গঠনের পর সেই দপ্তর বিলুপ্ত করে সেটাকে ডিসিসির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর থেকে সিটি করপোরেশনই মশক নিয়ন্ত্রণের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
কীটতত্ত্ববিদ সাইফুর রহমান বলেন, মশার সমস্যা শুধু ঢাকার নয়, সারা দেশের সমস্যা। দেখা যাবে কিছু দিনের মধ্যেই মশা কমে যাবে। তখন সিটি করপোরেশন মশা মারার যন্ত্রপাতি ও ওষুধ কেনায় মনোযোগ দেবে।
অক্টোবরে মশা যদি একটু কমে যায়, তাহলে সিটি করপোরেশন বলবে মশা নিয়ন্ত্রণ হয়ে গেছে। এতে করে মশা সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না। মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কীটতত্ত্ববিদদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। কারণ মেয়ররা আজ আছে, কয়েক বছর পর নেই। বারবার তারা জবাবদিহি করবে, তাও হয় না। একটি বিভাগের অধীনে থাকলে বিভাগটি সারা বছর জবাবদিহির আওতায় থাকে। তারাই তখন দেখবে ক্লাস্টারগুলোর অবস্থা কী, সেগুলো কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যায়। তারা ভাইরাসের গবেষণাও করবে। তিনি আরও বলেন, এসব বিষয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অনেকবার বলা হয়েছে। তারা বোঝেও না, বাস্তবায়নও করে না। সিটি করপোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, কারণ তাদের বিশেষজ্ঞ নেই, কীটতত্ত্ববিদ নেই। মশা নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী সমাধান করতে না পারলে প্রাণহানি ঘটতে থাকবে।
ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম শফিকুর রহমান বলেন, আমরা তো কীটতত্ত্ববিদদের পরামর্শ নিচ্ছি। আমাদেরও কীটতত্ত্ববিদ আছে। অনেকে মনে করছে আমরা হয়তো সারা বছর মশক নিয়ন্ত্রণে কাজ করি না। এটা ভুল। আমরা সারা বছর লার্ভিসাইডিং ও অ্যাডাল্টিসাইডিং করি। এখন আরও বেশি করছি। এ জন্য আলাদা একটি দপ্তর নতুন করে তৈরির কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। আমরা যেভাবে কাজ করছি শিগগিরই মশা কমে যাবে।
- বিষয় :
- ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ