- বাংলাদেশ
- দুদক আতঙ্কে কেনাকাটায় অনাগ্রহ উন্নয়ন ব্যাহত
সরকারের বর্ষপূর্তি-১০
দুদক আতঙ্কে কেনাকাটায় অনাগ্রহ উন্নয়ন ব্যাহত
স্বাস্থ্য খাত

ছবি: ফাইল
'স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অবস্থান'- শিরোনামে একটি বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইফস্টাইল, হেলথ এডুকেশন অ্যান্ড প্রমোশন স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর দেওয়া ওই বিজ্ঞপ্তিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ব্যাখ্যা করে বলা হয়, 'একই বিষয়ের ওপর গণমাধ্যমে বারবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে আলোচনা-সমালোচনার কারণে ক্রয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের ভীতির সঞ্চার করেছে। অনেকেই এ ধরনের পদে থাকতে চাইছেন না। আবার অনেকে ক্রয় প্রক্রিয়া থেকে দূরে থাকছেন কিংবা ক্রয় প্রক্রিয়া বিলম্বিত করছেন। এতে করে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন বিঘ্নিত ও সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়।' এ জন্য সবার সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
সংশ্নিষ্ট সূত্র বলছে, এটি শুধু বিজ্ঞপ্তি নয়, স্বাস্থ্য খাতের বাস্তব চিত্র। স্থবির হয়ে আছে সব কাজকর্ম। গত এক বছরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদকের অভিযানে স্বাস্থ্য খাতে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন, কেউ গ্রেপ্তার আতঙ্কে আছেন। আবার গ্রেপ্তার থেকে বাঁচতে কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, কেউ গা-ঢাকা দিয়েছেন। স্বাস্থ্য খাতে এক ভীতিকর পরিস্থিতি চলছে। দুদকের ভয়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা নিজেদের গুটিয়ে রেখেছেন। যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন চিকিৎসাসামগ্রীর প্রয়োজন হলেও তারা সেই প্রক্রিয়ায় হাত দিচ্ছেন না। এতে করে গত অর্থবছরে বড় ধরনের অর্থ ফেরত গেছে। চলতি অর্থবছরেও বরাদ্দ অর্থ ব্যয় হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে অর্থবছর শেষে বিপুল অর্থ ফেরত যাবে। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে। তবে কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্কের কথা অস্বীকার করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, অর্থবছরের বাকি ছয় মাসে অর্থ ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব সমকালকে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ এমনিতেই অনেক কম। এ কারণে জনপ্রতি স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৭ শতাংশ মানুষ নিজের পকেট থেকে ব্যয় করে। এরপরও যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা ব্যয় করতে না পারা দুঃখজনক। জনগণের স্বাস্থ্যসেবা আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। আইন মেনে দুর্নীতি যাতে না হয়, সেভাবে কেনাকাটা সম্পন্ন করা হলে কোনো সমস্যা নেই। ভয়ের কোনো কারণ নেই। সততার সঙ্গে কেনাকাটা করলে দুদককে কেন ভয় করতে হবে। সুতরাং, জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনা করে এ ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
অপারেশনাল প্ল্যানের (ওপি) বিভিন্ন প্রোগ্রামে যুক্ত অন্তত পাঁচ শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে সমকাল জানতে পেরেছে, দুদকের চলমান অভিযানে ক্রয় প্রক্রিয়ায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন না সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা। সারাদেশে সরকারি হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজে যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন চিকিৎসাসামগ্রীর প্রয়োজন হয়। অথচ দুর্নীতির ভয়ে সবাই হাত গুটিয়ে বসে আছেন। কেউ টেন্ডার আহ্বান করছেন না। এমনকি কেনাকাটার বকেয়া পরিশোধের জন্যও তারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিংবা মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখছেন না। ঠিকাদাররা মাসের পর মাস ঘুরেও বকেয়া বিল তুলতে পারছেন না। এতে করে এক ধরনের স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে অর্থবছরের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও মোট বরাদ্দের ১০ শতাংশ অর্থও ব্যয় করতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ অবস্থায় আগামী ৩০ জুনের মধ্যে বাকি ৯০ শতাংশ অর্থ ব্যয় নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তা বলেন, বিগত বছরগুলোতে প্রথম ছয় মাসের মধ্যে উন্নয়নমূলক কাজের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ব্যয় হতো। আর শেষ ছয় মাসে বাকি অর্থ ব্যয় করা হয়। কিন্তু এবার প্রথম ছয় মাসে ১০ শতাংশ অর্থও ব্যয় হয়নি। এ অবস্থায় আগামী ছয় মাসের মধ্যে বাকি ৯০ শতাংশ অর্থ ব্যয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই। এতে করে অব্যয়িত অর্থ ফেরত চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ সমকালকে বলেন, অন্যান্য খাতের মতো স্বাস্থ্য খাতও দুর্নীতির বাইরে নয়। তবে অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে সবসময়ই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মন্ত্রণালয় নিজ উদ্যোগে তদন্ত করে অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। সুতরাং, অনিয়ম করে কেউ রেহাই পায় না। কিন্তু বর্তমানে এক ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আর্থিক সংশ্নিষ্টতা আছে- এমন কাজ করতে কর্মকর্তারা অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। এতে করে কাজকর্মে গতিশীলতা হ্রাস পেতে পারে। সুতরাং, সবার প্রতি আহ্বান থাকবে, স্বচ্ছতার সঙ্গে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করুন। এতে ভয়ের কিছু নেই।
টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসামগ্রী ক্রয় না করা অত্যন্ত দুঃখজনক। স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া প্রত্যেক মানুষের অধিকার। প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসামগ্রীর অভাবে মানুষ সঠিক স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত হচ্ছে; যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সংশ্নিষ্ট শাখার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যখন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এ ধরনের বক্তব্য দেয়, তখন তাদের পদে থাকার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। কেনাকাটা করলে অনৈতিক পন্থায় অর্থ আয় করা যায়- এমনটি হয়তো কর্মকর্তারা ধরে নিয়েছিলেন। যেহেতু দুর্নীতি করা যাবে না, তাই কেনাকাটাও বন্ধ রয়েছে। এ ধরনের ব্যক্তিদের কখনও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা উচিত নয়। সব অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করে স্বচ্ছতার সঙ্গে দ্রুত চিকিৎসাসামগ্রী হাসপাতালে পৌঁছানোর মাধ্যমে সংশ্নিষ্টরা জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
অগ্রগতির চিত্র :বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির পরও গত এক বছরে স্বাস্থ্য খাতে কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেছে। ৩৯তম বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে চার হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দিয়ে সম্প্রতি তাদের উপজেলায় পদায়ন করা হয়েছে। নতুন করে দেশের পাঁচ জেলা নওগাঁ, নীলফামারী, মাগুরা, চাঁদপুর ও নেত্রকোনায় মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। গত বছর থেকেই এসব মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য কার্ড ও তথ্য সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে নেওয়া হয়েছে বেশকিছু পদক্ষেপ। এর অংশ হিসেবে যন্ত্রপাতি, চিকিৎসা সরঞ্জাম, আসবাবপত্র সরবরাহ করা হয়েছে। ৪০ উপজেলায় সাত ধরনের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে। দুর্গম এলাকার উপজেলাগুলোতে ২৮টি অ্যাম্বুলেন্স ও ১০টি নৌ অ্যাম্বুলেন্স প্রদান এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত ৬৯ উপজেলায় ৪৩২টি মোবাইল মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনা করা হয়েছে। এ ছাড়া ৯৪ হাসপাতালে উন্নতমানের টেলিমেডিসিন কার্যক্রম চালু হয়েছে। অগ্রগতি আছে ওষুধ খাতেও। প্রতিবছর ওষুধের বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। বিশ্বের ১৬৮ দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, দেশে স্বাস্থ্যসেবার সম্প্রসারণ ঘটেছে। তবে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক মানুষ চিকিৎসার জন্য এখনও বিদেশে যাচ্ছেন। সরকারের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরাও ঘটা করে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। এতে করে বলা যায়, দেশের চিকিৎসাসেবার মান কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছায়নি। তবে ভালো দিক হলো, ওষুধ উৎপাদনে দেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশীয় চাহিদা পূরণ করে বিশ্বের প্রায় ১৬৮ দেশে ওষুধ রপ্তানি করা হচ্ছে। এরপরও দেশে ব্যাপকহারে নকল, ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। আবার প্রতিবছর ওষুধের মূল্য বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে ওষুধের মূল্য দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসকদের ফি, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ফি অনেকাংশে অনিয়ন্ত্রিত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অসন্তোষজনক।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, কোনো সংস্থার ভয়ে নয়, স্বাস্থ্য খাতে অপ্রয়োজনীয় কোনো যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হচ্ছে না। এ বিষয়ে সবাইকে নির্দেশনা দিয়েছি। সে অনুযায়ী বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির তালিকা চাওয়া হয়েছে। তাদের পাঠানো তালিকা ধরে যন্ত্রপাতি কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস কাজকর্মে গতি একটু কম থাকে। পরবর্তী ছয় মাস দ্রুতগতিতে কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। এটি শুধু এবারই নয়, বিগত অর্থবছরেও এভাবে কাজ হয়েছে। সুতরাং বাকি ছয় মাসে দ্রুতগতিতে কাজ করে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা হবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সেসব সিদ্ধান্তের সুফল আসতে শুরু করেছে। এর মধ্যে একটি হলো উপজেলা পর্যায়ে কর্মস্থলে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা। আগে এ হার ছিল ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। বর্তমানে তা ৮০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এ ছাড়া আগে মেশিন নষ্ট হলে তা ফেলে রাখা হতো। সেটি আর ব্যবহার করা যেত না। এভাবে এক সময় সেটি ব্যবহার অনুপযোগী বলে ঘোষণা করা হতো। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ওইসব যন্ত্রপাতি মেরামত করে রোগীর সেবায় ফিরিয়ে আনা হবে। এতে হিসাব করে দেখা গেছে, সরকারের দেড় হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। এ ছাড়া প্রয়োজনের অতিরিক্ত এমএসআর সামগ্রী কোনো হাসপাতালে দেওয়া হবে না। এভাবে সরকারের অর্থ সাশ্রয় করে স্বাস্থ্য খাতকে জনমুখী খাতে পরিণত করা হবে।
মন্তব্য করুন