- বাংলাদেশ
- এত মামলার ভবিষ্যৎ কী
এত মামলার ভবিষ্যৎ কী
আদালতের নির্দেশনার পরও মিলছে না মেডিকেল সনদ ও বিশেষজ্ঞ মত, ন্যায়বিচার না পেয়ে হতাশ ভুক্তভোগীরা

২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার জিল্লুর রহমান বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেছিলেন। ওই মামলার অভিযোগে বলা হয়, ৪ ফেব্রুয়ারি শিশু সার্জারি-১ এর ইনডোর মেডিকেল অফিসার ডা. শর্মিষ্ঠা ও ইন্টার্ন চিকিৎসক ফারহানাকে মারধর করা হয়েছে। ঢামেকে ভর্তি শিশু আসফিদার বাবা কোরবান আলীসহ ১০-১২ জন ওই দুই চিকিৎসককে মারধরের ঘটনায় জড়িত। তারা জোরপূর্বক শিশু সার্জারি বিভাগে ঢুকতে চাইলে নিষেধ করেন চিকিৎসকরা। আসফিদার স্বজনরা ডা. ফারহানাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেন। একের পর এক আঘাত করতে থাকেন। এতে ডা. ফারহানার ডান হাতের তালু ফেটে রক্ত বের হতে থাকে। তাকে উদ্ধারের পর ক্যাজুয়ালটি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হয়। স্বজনরা ডা. শর্মিষ্ঠার ওড়না ধরে টান মারেন। জোরপূর্বক ওয়ার্ডে ঢুকে জানালার কাচ ও দরজা ভাঙচুর করতে থাকেন। মামলায় এও বলা হয়, বিবাদী কোরবান আলীসহ অন্যরা ওয়ার্ডের দরজা- জানালা ভাংচুর করে এক লাখ টাকার ক্ষতি সাধন করেছেন। পেনাল কোডের ১৪৩/৪৪৮/৩২৪/৫০৬/৪২৭ ধারায় শাহবাগ থানায় ওই মামলা করা হয়েছিল।
প্রায় তিন বছর পার হলেও এ মামলার তদন্ত আলোর মুখ দেখেনি। একাধিক তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তনের পরও তা ডিপ ফ্রিজে। জানা গেছে, আহত চিকিৎসকের মেডিকেল সনদপত্র না পাওয়ায় তদন্ত সম্পন্ন হচ্ছে না। মেডিকেল সনদ দিতে আদালত আদেশ দিলেও এখনও তা পাওয়া যায়নি। ওই মামলার মেডিকেল সনদ পেতে ২০১৮ সালের ৩১ মে মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে আবেদন করেন শাহবাগ থানার এসআই সাহেব আলী। সেখানে তিনি বলেন, 'মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে জখম হওয়া চিকিৎসকের ডাক্তারি সনদপত্রের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বরাবর আবেদন করা হয়। এ ছাড়া সশরীরে উপস্থিত হয়ে সনদপত্র নেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু সনদপত্র পাওয়া যায়নি। তাই মামলাটি নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। ডাক্তারের সনদপত্র জরুরিভাবে সরবরাহ করার জন্য বিজ্ঞ আদালতের আদেশ একান্তভাবে প্রয়োজন।' ওই আবেদনের পর ২০১৮ সালের ৬ আগস্ট আদালত ডাক্তারি সনদপত্র তদন্ত কর্মকর্তাকে প্রদানের আদেশ দেন। আদেশে বলা হয়, 'ভিকটিমদ্বয়ের জখমি সনদপত্র প্রেরণের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে প্রদান করা হলো।'
আদালতের আদেশের পরও দীর্ঘদিন পার হয়েছে। তবু মেলেনি জখমি সনদপত্র। শুধু শাহবাগ থানার ওই মামলা নয়, মেডিকেল সনদপত্র ও বিশেষজ্ঞ মতামত না পাওয়ায় ঢাকার ৫০ থানায় শতাধিক মামলার তদন্ত বছরের পর বছর আটকে আছে। এসব মামলার ভবিষ্যৎ কী, তা জানা নেই তদন্ত সংশ্নিষ্টদেরও। এমন পরিস্থিতিতে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। বছরের পর বছর মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় নষ্ট হচ্ছে মামলা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ আলামত।
কেন কী কারণে বছরের পর বছর মামলার তদন্ত আটকে আছে তার অনুসন্ধান করা হয় পুলিশের পক্ষ থেকেও। সেখানে ঢাকার বিভিন্ন থানায় দায়ের করা শতাধিক মামলার তদন্ত আটকে থাকার পেছনে ডাক্তারি সনদ ও বিশেষজ্ঞ মতামত না পাওয়াকে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, কিছু মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে ডাক্তারি সনদপত্র, বিশেষজ্ঞ মতামত, মাদক এবং অস্ত্রের পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পাওয়া জরুরি। আবার অনেক মামলার তদন্ত নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করার ক্ষেত্রে আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে অনেক দিন পার হওয়ার পরও ডাক্তারি সনদপত্র ও বিশেষজ্ঞ মতামত না পাওয়ায় তদন্তের সুরাহা হচ্ছে না। ঢাকায় বিভিন্ন থানায় শতাধিক মামলার তদন্ত এসব কারণে আটকে আছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন সমকালকে বলেন, একজন রোগী যখন হাসপাতালে ভর্তি হন, তখন প্রয়োজনে তাকে একাধিক চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিতে হয়। পরে যখন মেডিকেল সনদ নেওয়ার বিষয়টি আসে, তখন সব চিকিৎসকের মতামত নিতে হয়। এটা কিছুটা সময় সাপেক্ষ। আবার অনেকে সনদ নিতে আসার পর চিকিৎসা সংক্রান্ত অরিজিনাল কাগজপত্র দেখাতে পারেন না। এ ছাড়া প্রত্যেক চিকিৎসককে তার দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি মেডিকেল সনদ দিতে হয়। মেডিকেল সনদ দেওয়ার জন্য আলাদা কোনো জনবল নেই। প্রতিদিন ৫ থেকে ১০০টির মতো পুলিশ কেস ঢাকা মেডিকেল কলেজে আসে। এগুলো চিকিৎসকদের দেখতে হয়। এর পরও চাঞ্চল্যকর ঘটনার মামলার দ্রুত মেডিকেল সনদ দেওয়া হয়। অন্য মামলার মেডিকেল সনদও পর্যায়ক্রমে দেওয়া হচ্ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ডে ভাংচুর ও ডাক্তারদের ওপর হামলার মামলায় বাদী হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার জিল্লুর রহমান সমকালকে বলেন, এখনও তদন্ত শেষ হয়নি। জানি না কবে বিচার হবে।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর হাসান আলী নামে এক ব্যক্তি বাদী হয়ে নিউমার্কেট থানায় একটি মামলা করেন। সেই মামলার অভিযোগে বলা হয়, 'নিউমার্কেট থানাধীন বৃহত্তর যশোর সমিতির ভবনের গেটে ভ্যানগাড়ি সরানোকে কেন্দ্র করে অভিযুক্ত ইলিয়াস হোসেন, আব্বাস, শাওন, কাজী মোবারক হোসেন, কবির হোসেনসহ ১০-১২ জনের সঙ্গে হাসান আলীর কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে আব্বাস ও শাওন তাদের হাতে থাকা কাঠের চলা দিয়ে হাসানের মাথা ও দু'হাতে জোরে আঘাত করেন। অন্যরা তাকে কিলঘুষি মারতে থাকেন। এ ঘটনায় হাসান বাদী হয়ে পাঁচজনের নাম উল্লেখসহ ১০-১২ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করেন। তবে দীর্ঘ দিনেও ডাক্তারি সনদ না পাওয়ায় ওই মামলার তদন্তে কোনো গতি নেই। হাসান আলীর দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিউমার্কেট থানার এসআই আলমগীর হোসেন মজুমদার ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বরাবর একটি আবেদন করেন। সেই আবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, কেন কী কারণে ডাক্তারি সনদপত্র জরুরি। হাসপাতাল থেকে মেডিকেল সনদ না পেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন তদন্ত কর্মকর্তা। পরে আদালত ওই মামলার ক্ষেত্রেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালককে মেডিকেল সনদ প্রদানের নির্দেশ দেন। আদালতের নির্দেশের পর এখনও হাসান আলীর দায়ের করা মামলার মেডিকেল সনদ পাওয়া যায়নি।
মামলার বাদী হাসান আলী সমকালকে বলেন, মেডিকেল সনদ না পাওয়ায় মামলার তদন্ত শেষ করতে পারছে না পুলিশ। বাদী হিসেবে আমার আর কী করার আছে!
মন্তব্য করুন