করোনাভাইরাস এখন বিশ্বব্যাপী আতঙ্কের নাম। চীনে এর সংক্রমণে মৃতের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি দেশে আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। অনেক দেশ সংক্রমণ থেকে বাঁচতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কোনো কোনো দেশ চীনের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করেছে। কোনো কোনো দেশ চীনা নাগরিকদের নিজ দেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে মাত্র ৩৫ দিনেই চীনের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ রয়েছে এমন দেশের অর্থনীতিও ঝুঁকিতে পড়েছে। বাংলাদেশের জন্য এই ঝুঁকি অনেকের চেয়ে বেশি।

বাংলাদেশের মোট আমদানির ২৫ শতাংশের বেশি হয়ে থাকে চীন থেকে। আবার ১০০ কোটি ডলারের মতো রপ্তানিও হয়ে থাকে দেশটিতে। প্রায় এক হাজার ৬০০ কোটি ডলারের ব্যবসা রয়েছে চীনের সঙ্গে। এ ছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ও বেসরকারি খাতে শত শত চীনা নাগরিক কাজ করছেন। যাদের একটি অংশ ছুটি কাটাতে দেশে গিয়ে আর ফিরতে পারছেন না। ফলে এসব প্রকল্প এবং শিল্পকারখানা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে।

ব্যবসায়ীরা ও উন্নয়ন প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলছেন, করোনাভাইরাস দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না এলে বাংলাদেশ বিপদে পড়বে। চীনে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি যে রপ্তানি হয়, তা অনেকটা কমে যাবে। এরই মধ্যে কয়েকটি পণ্যে কমতে শুরু করেছে। অন্য দেশে যেসব পণ্য রপ্তানি হয় তার কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যের বড় অংশ আসে চীন থেকে। আবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের রপ্তানির কার্যাদেশও আসে চীন হয়ে। ফলে দেশের  সামগ্রিক রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে চীনের অনেক পণ্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে রয়েছে। যার মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যও রয়েছে। ফলে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না এলে অনেক খাতের পণ্যই সময়মতো আমদানি করা যাবে না। ফলে অভ্যন্তরীণ সরবরাহ কমে যেতে পারে।

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, চীনের মতো উৎপাদনমুখী অর্থনীতিতে এ ধরনের ঘটনা দীর্ঘায়িত হলে তা সবাইকেই নাড়িয়ে দেবে। বাংলাদেশে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। চীনের অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তায় যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে দেশের প্রধান শিল্প বস্ত্র ও পোশাক খাতের কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হবে; যা প্রধান রপ্তানি আয়ের খাতে ঝুঁকি তৈরি করবে। এ ছাড়া দেশের প্রচুর ব্যবসায়ী চীন থেকে বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামাল আমদানি করে উৎপাদনে কাজে লাগান। তৈরি পণ্য এনে দেশে বিক্রি করেন। তারা এরই মধ্যে ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তারা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

উন্নয়ন প্রকল্পে প্রভাব : বর্তমানে চীনা অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তায় দেশে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এসব প্রকল্পে চীনা নাগরিকরা কাজ করছেন। নববর্ষ উপলক্ষে প্রকল্পগুলোর চীনা কর্মীদের একটি অংশ নিজ দেশে ছুটি কাটাতে গিয়ে আটকে পড়েছেন। এতে এসব বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পের বাস্তবায়ন গতি কমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যেতে পারে। পদ্মা সেতু, পদ্মা রেল সংযোগ সেতু, পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন, কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা বাইপাস সড়ক উন্নয়নসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রকল্পে চীনের নাগরিকরা বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত আছেন। এসব প্রকল্পে দেড় হাজার চীনা নাগরিক কাজ করছেন বলে জানা গেছে। তার বাইরে আরও কিছু প্রকল্পে ৫০০ চীনা নাগরিক সহায়তা করছেন।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, বর্তমানে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ৭৫০ জন চীনা নাগরিক কাজ করছেন। আর ছুটিতে গেছেন প্রায় ৩০০ জন। চীন থেকে সদ্য ফেরত এসেছেন এমন ৩২ জনকে আলাদা করে বিশেষ পর্যবেক্ষণে (কোয়ারেন্টাইন) রাখা হয়েছে। কোয়ারেন্টাইন থেকে কয়েকজন নিরাপদ প্রমাণিত হওয়ায় কাজে ফিরেছেন। বাকিদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। আর যারা ছুটিতে চীনে অবস্থান করছেন, তারা কবে ফিরবেন বা আদৌ ফিরতে পারবেন কিনা, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। ফলে প্রকল্পের কার্যক্রম কিছুটা হলেও গতি হারিয়েছে। আর ছুটিতে থাকা চীনা নাগরিকরা সময়মতো না ফিরলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন ব্যাহত হবে। তবে পরিস্থিতির ওপর বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। উল্লেখ্য, পদ্মা সেতুর বিভিন্ন কাজে প্রায় এক হাজার ১০০ চীনা নাগরিক কর্মরত। যাদের মধ্যে প্রকৌশলী, ভূতত্ত্ববিদসহ বিশেষ কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন লোক রয়েছেন।

মাতারবাড়ি প্রকল্পের পরিচালক আবুল কাশেম সমকালকে বলেন, 'চীনা নাগরিকদের উদ্দেশ্যে নোটিশ করা হয়েছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে কেউ চীনে যাবেন না। আর যারা চীনে অবস্থান করছেন তারা বাংলাদেশে আসবেন না। অবশ্য এতে প্রকল্পের কার্যক্রমে বিশেষ অসুবিধা হবে না বলে তিনি মনে করেন। জানা গেছে, এই প্রকল্পের প্রায় ৩০ জন ছুটি কাটাতে চীন গেছেন।

দোহাজারী-ঘুনধুম রেললাইন স্থাপন প্রকল্পের পরিচালক মফিজুর রহমান সমকালকে বলেন, এই প্রকল্পে ৮০ জন চীনা নাগরিক কাজ করছিলেন। এর মধ্যে ৩১ জন ছুটি কাটাতে চীনে গেছেন। আজ ৫ ফেব্রুয়ারি এসব কর্মীর ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে তারা জানিয়েছেন, এখনই ফিরছেন না। এজন্য বুধবার (আজ) তাদের নিয়ে যে পূর্বনির্ধারিত মিটিং ছিল, তা বাতিল করা হয়েছে। এদিকে যেসব চীনা নাগরিক বর্তমানে প্রকল্পে কর্মরত তারা আপাতত চীনে যাবেন না।

পটুয়াখালীর পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রায় দুই হাজার ৭০০ চীনা নাগরিক কাজ করছেন। যাদের অনেকেই ছুটি কাটাতে চীনে গেছেন। তাদের মধ্যে জানুয়ারির ২৩ থেকে ২৭ তারিখে ফিরেছেন ২০ জন, যাদের আলাদা করে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম খুরশিদুল আলম সমকালকে বলেন, ২৬৫ জন চীনা নাগরিক বর্তমানে ছুটিতে তাদের দেশে অবস্থান করছেন। তারা চীন সরকারের ছাড়পত্র না পেলে ফিরতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন। এদিকে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে দেশটির নাগরিকদের আগমনী ভিসা বন্ধ করেছে। ফলে অন্যান্য খাতের কর্মীরাও আসতে পারছেন না।

রপ্তানিতে ধাক্কা : পণ্য উৎপাদনে চীন থেকে প্রচুর কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এসব পণ্যের একটি অংশ দেশে বিক্রি হয়, আরেকটি অংশ রপ্তানি হয়। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামাল যেমন- সুতা ও কাপড়ের উল্লেখযোগ্য অংশ আমদানি হয় চীন থেকে। সময়মতো কাঁচামাল আনতে পারছেন না অনেকেই। এর ফলে রপ্তানি পণ্য তৈরিতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। পোশাক খাতের ক্রেতাদের একটি অংশ চীনের সাংহাই, গুয়াংজো ও হংকংয়ে বসে দরকষাকষি করে থাকেন। সেখানে যেহেতু এখন যাতায়াত করা ঝুঁকিপূর্ণ, ফলে এই যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে।

দেশের অন্যতম শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ডিবিএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ জব্বার সমকালকে বলেন, চীনের এই পরিস্থিতিতে পুরো বিশ্বই ক্ষতির মুখোমুখি। তবে বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে বেশি। কারণ পোশাক উৎপাদনের অনেক কাঁচামালের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল। আবার বস্ত্র ও পোশাক কারখানার সুতা ও কাপড় আমদানি হয় চীন থেকে। এসব পণ্য সময়মতো না এলে তৈরি পোশাকের রপ্তানি ব্যাহত হবে। তিনি নিজের কোম্পানির উদাহরণ দিয়ে বলেন, 'আমাদের অনেক পণ্য আটকে গেছে। এখন আমরা বিকল্প দেশ থেকে সেগুলো সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি। তাতে বেশি খরচ পড়ছে। আবার সময়মতো পাওয়ার নিশ্চয়তা পাচ্ছি না। ভারতের সঙ্গে আলোচনা করছি; কিন্তু ভরসা করা যাচ্ছে না।' সামগ্রিক পরিস্থিতিতে নিজেদের ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করা যাবে কিনা, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন এই উদ্যোক্তা।

পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানিও ব্যাহত হচ্ছে। চামড়া ও পাট পণ্য রপ্তানি হচ্ছে না। বন্ধ হয়ে গেছে কাঁকড়া ও কুচে রপ্তানি। তৈরি পোশাকেরও একই অবস্থা। আকিজ জুট মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম এ নাসিরউদ্দিন সমকালকে বলেন, চীনের এই পরিস্থিতিতে পাট ও পাট পণ্য রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইতোমধ্যে তা শুরু হয়েছে। পাট খাতের সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, বেশ কয়েকটি রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে চীনে পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, তৈরি পোশাক, কাঁকড়া, কুচে রপ্তানি হয়। গত বছর ১৬ কোটি ডলারের চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। বাংলাদেশে উৎপাদিত পাটের সুতার দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রেতা চীন। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে চীন বাংলাদেশ থেকে চার কোটি ৬১ লাখ ডলারের পাটের সুতা আমদানি করেছে। এ সময়ে এক কোটি ১৬ লাখ ডলারের কাঁচাপাট রপ্তানি হয়েছে দেশটিতে।

আমদানিতে নেতিবাচক প্রভাব : চীনের বিভিন্ন রাজ্যের কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। ছুটি বাড়ানো হয়েছে ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। বন্ধ রাখা হয়েছে গণপরিবহন। এক এলাকার পরিবহন অন্য এলাকায় যাতায়াত করছে না। এ ছাড়া দেশটির বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম সংকুচিত হয়েছে। ফলে পণ্য জাহাজীকরণ, বুকিং এসব হচ্ছে না। এতে দেশটি থেকে পণ্য আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। চীন থেকে পণ্যের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য, শিল্পের মেশিনারিজ, তৈরি পণ্য আমদানি হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ ছিল ১৩ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার, যা ওই অর্থবছরের মোট আমদানির ২৬ দশমিক ১ শতাংশ। এই বিপুল পরিমাণ আমদানি ঠিকমতো না হলে সরকারের রাজস্ব আয়ও কমবে।

অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রভাব : চীন থেকে ফল আমদানি হয়। ইতোমধ্যে ফলের বাজারে করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে। রসুন ও আদার বাজারেও চড়াভাব দেখা দিয়েছে। দেশে সার্জিকাল মাস্কের দাম বেড়েছে। চীন থেকে ভ্যাট হিসাব করার যন্ত্র ইএফডি আমদানি করে বসানোর পরিকল্পনা ছিল এনবিআরের। এই প্রকল্পের কারিগরি বিশেষজ্ঞও চীনা নাগরিক। কিন্তু মেশিন আমদানি যেমন বাকি রয়েছে, তেমনি কারিগরি বিশেষজ্ঞরা আসতে পারছেন না। ফলে ভ্যাট ব্যবস্থা আধুনিকায়নের উদ্যোগটিও থমকে গেছে।

বিমান সংস্থার ব্যবসা কমছে : এরই মধ্যে জার্মানি, ফিলিপাইন, যুক্তরাষ্ট্রেও করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ চীনা নাগরিকদের অন-অ্যারাইভাল ভিসা বন্ধ করেছে। আবার দেশ থেকে চীনে যাওয়ার বিষয়েও নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। অন্যদিকে চীনে বা উহান প্রদেশে বিমান নিয়ে যাচ্ছেন যেসব পাইলটরা, তাদের ভিসা দিচ্ছে না অন্য দেশ। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে যেসব বিমান কোম্পানি চীন ও চীনের বিভিন্ন রাজ্যে ফ্লাইট পরিচালনা করে তাদের ব্যবসা কমেছে। জানা গেছে, অনেক ব্যবসায়ী ইতোমধ্যে তাদের বুকিং বাতিল করেছে।