নোয়াখালীর নোনা মাটির সুবর্ণচরে যতদূর চোখ যায়, ততদূরই কেবল সবুজ আর সবুজ। কারণ কৃষিতে ঝুঁকছেন চরের মানুষ। আর সেই চাষাবাদে পুরুষের চেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছেন নারীরাই।

এমনই একজন সুরমা বেগম। তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল চরনাঙ্গুলিয়ায়। হাতিয়া উপজেলায় নদী ভাঙনের শিকার হয়ে তিনি এখন এখানে চাষবাস করছেন। অভাবের সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে ভূমিহীন হিসেবে বরাদ্দ পাওয়া দেড় একর জমিতে চাষাবাদ শুরু করেন তিনি। নিজের কিছু টাকায় প্রথমে স্বল্প পরিসরে শুরু করেন গরুর খামার, মাছ আর সবজির চাষাবাদ। কয়েক বছরের ব্যবধানে সুরমা এখন এলাকায় নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত।

সুরমার পুকুরে মাছ চাষ হয়, পানিতে সাঁতার কাটছে হাঁস। তার পাড়ে শিম, শসা, বরবটি, করলা, লাউ, কুমড়া, ঝিঙে ও পটোলের চাষ হচ্ছে। বাড়ির পাশের জলাশয়ের পানির ওপর চলছে বানানো মাচায় লতানো সবজি চাষ। সুরমা বললেন, 'নিজে উপার্জন করতে কার না ভালো লাগে। ছোট পরিসরে খামার করছি। ডেইরি ফার্মে প্রতিদিন ৩৬ টাকা করে ৫-৬ লিটার দুধ বিক্রি করি। মুরগির ডিম ও হাঁসের ডিমও বেচি। প্রচুর সবজি ও মাছ পাচ্ছি।' তবে আক্ষেপও আছে তার। তার মতে, 'এত উৎপাদনের পরও সঠিক দাম পাচ্ছি না। বাজারে পণ্য বিক্রির জন্য যেতে পারি না। বাড়িতে লোক এসে পণ্য নিয়ে যায়। কারণ স্থানীয়ভাবে নারীদের জন্য আলাদা নারীবান্ধব বাজার ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। বড় পরিসরের কৃষি বাজারজাতকরণে তাকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, বর্তমানে কৃষি খাতে নিয়োজিত আছেন ৯০ লাখ ১১ হাজার নারী। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৯০ শতাংশ বাড়িতে মুরগি পালন নিয়ন্ত্রণ করেন নারী। ছাগল ও গরু পালনে নারীদের নিয়ন্ত্রণ ৫৫ শতাংশ।

তবে গ্রামীণ নারীদের উপযোগী বাজার ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় তারা উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি হতে পারছেন না।

মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে তারা উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। আবার নারীবান্ধব না হওয়ায় স্থানীয় বাজারে নিজেদের পণ্য বিক্রিও একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এসকেএস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রাসেল আহমেদ লিটন বলেন, গ্রামীণ নারীদের আগ্রহ থাকলেও উপযুক্ত পরিবেশ ও সুযোগের অভাবে তারা মূল বাজারের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন না। দক্ষতা থাকলেও তারা জানেন না কীভাবে তা কাজে লাগিয়ে আয়-উপার্জন করা যায়, অর্থনৈতিকভাবে স্ববলম্বী হওয়া যায়।

পুরুষ ব্যবসায়ীদের দখলে মহিলা মার্কেট : মার্কেটের নাম 'মহিলা মার্কেট।' নিয়মানুযায়ী, এখানকার ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই নারী হওয়ার কথা। পুরুষরা ক্রেতা হিসেবে এলেও সঙ্গে পরিবার নিয়ে আসার কথা। কিন্তু বাস্তবে পুরুষ ব্যবসায়ীদেরই দখলে দেশের সব মহিলা মার্কেট। গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের মূল বাজার ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত করতে নানা সময়ে নেওয়া হয়েছে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ। কিন্তু বাস্তবতা হলো প্রকল্পনির্ভর এসব উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদে তেমন ফল বয়ে আনেনি।

বাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে ২০০১ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে আট বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প হাতে নেয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। কিন্তু নানা কারণে তা দেখেনি সাফল্যের মুখ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কৃষিবিদ হামিদুর রহমান বলেন, প্রকল্পটির নাম ছিল নর্থ-ওয়েস্ট ক্রপ ডাইভারসিফিকেশন প্রজেক্ট। এই প্রজেক্টের গ্রোথ সেন্টারগুলোতে মেয়েদের দোকান পরিচালনা কার্যক্রমের ধারণাও পরীক্ষা করা হয়।

গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০২ অর্থবছর পর্যন্ত স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সারাদেশের সব উপজেলায় তিনটি করে মার্কেট নির্মাণ করে। ২০০৩ সালের মাঝামাঝি সময় এগুলো চালু করা হয়। কথা ছিল এগুলোর দোকান বরাদ্দ করা হবে নারীদের মধ্যে। কিন্তু শুরুতেই এ শর্ত অমান্য করা হয়। সরকারের এ উদ্যোগ এলজিইডি কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্নিষ্ট পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধিদের চরম উদাসীনতায় মার্কেটগুলো নারী উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে বেহাত হয়ে যায়। ফলে ভেস্তে যায় সরকারের মূল উদ্দেশ্য।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কলাপাড়া পৌর শহরের মহিলা মার্কেটের দোকানগুলো প্রভাবশালীরা নিজেদের নামে বরাদ্দ নিয়ে সাবলেট দিয়েছে। এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে মহিলা মার্কেট কথাটি পর্যন্ত লেখা নেই। লালমনিরহাটের আদিতমারীতে বুড়িরবাজার মহিলা বিপণিবিতানের আটটি দোকানের সাতটিই পুরুষদের দখলে। কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে নির্মিত অত্যাধুনিক মহিলা মার্কেট দীর্ঘ ১৭ বছরেও বরাদ্দ দিতে পারেনি উপজেলা প্রশাসন। নির্মাণের পাঁচ বছরেও চালু হয়নি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শোভাগঞ্জ বাজারে নির্মিত মহিলা মার্কেট। সিরাজগঞ্জের তাড়াশে তিনটি মার্কেটও নামেই মহিলা মার্কেট- নারী ব্যবসায়ী না থাকার অজুহাতে বরাদ্দ নিয়ে এক যুগ ধরে সেখানে ব্যবসা করছেন পুরুষরাই। ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার দুটি মহিলা মার্কেটও পুরুষের দখলে।

স্থানীয় নারী উদ্যোক্তারা বলছেন, এ মার্কেট নারীদের নামে আছে, কাজে নেই। নারীরা সেলাইসহ খুদে দোকান পরিচালনা করছেন- কিন্তু তাদের নিজস্ব দোকানপাট নেই। ওইসব নারীর মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হলে সরকারের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হতো। আবার অনেক প্রশিক্ষিত মহিলা রয়েছেন, যাদের ওই কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হলে সরকারের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হতো।

সরকারের নতুন উদ্যোগ : গ্রামীণ নারীদের বাজার ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সরকার নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছে। 'দেশব্যাপী গ্রামীণ বাজার অবকাঠামো উন্নয়ন' প্রকল্পের আওতায় দেশের ৪৯১ উপজেলায় ১ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে বহুতলবিশিষ্ট গ্রামীণ বাজার নির্মিত হচ্ছে। এসব উপজেলায় কমপক্ষে একটি করে তিনতলাবিশিষ্ট ৫২০টি বাজার তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিটা বাজারে নারীদের জন্য থাকছে আলাদা ফ্লোর, যেখানে নারীরা উৎপাদিত পণ্য কেনাবেচা করতে পারবেন। এ প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত।

সফল উদ্যোগ : নারীবান্ধব বাজার নিশ্চিতে বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নিয়েছে নানা পদক্ষেপ। সম্প্রতি শেষ হয়েছে অ্যাকশনএইডের তেমনই একটি প্রকল্প। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের 'মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর উইমেন (এমএমডব্লিউডব্লিউ)' প্রকল্প বর্তমান বাজার ব্যবস্থায় নারী উদ্যোক্তাদের অবস্থান ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। এ প্রকল্পের সুফল পেয়েছেন বহু নারী। তৃণমূলের নারী কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হচ্ছে রাজধানীর গুলশানের বিক্রয়কেন্দ্র আউড়িতে। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের উদ্যোগে গত বছরের ১১ এপ্রিল যাত্রা শুরু করে এটি। সংস্থাটির প্রমোটিং অপরচুনিটিজ ফর উইমেন্স এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড রাইটস (পাওয়ার) প্রকল্পের আওতায় গাইবান্ধা ও লালমনিরহাটসহ বিভিন্ন জেলার ছয় হাজারের বেশি নারী-কৃষক তাদের জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত পণ্য সরাসরি আউড়িতে পাঠাচ্ছেন। নারী কৃষক দল ও ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে পণ্য বিক্রির জন্য দালালকে কোনো টাকা না দিয়েই পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন কৃষকরা।

অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্‌ কবির বলেন, গ্রামীণ কৃষি উদ্যোক্তারা, বিশেষ করে নারীরা যেন উপযুক্ত পরিবেশ পায় এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় সরাসরি অংশ নিতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উভয় পক্ষকে কাজ করতে হবে।

অ্যাকশনএইডের এমএমডব্লিউডব্লিউ প্রজেক্টের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর ড. মোহাম্মদ শওকত আকবার ফকির বলেন, গ্রামে নারীর উৎপাদিত পণ্যও পুরুষরাই বিক্রি করেন। টাকাটাও তারাই খরচ করেন। এভাবে পিছিয়ে পড়ে নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জনে বিঘ্ন ঘটে। তাই তারা এখন এলাকাভিত্তিক নারীবান্ধব বাজার তৈরিতে কাজ করছেন, যেখানে নারীরা নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করার সুযোগ পান এবং যেখানে ব্রেস্টফিডিং কর্নার থাকবে।