- বাংলাদেশ
- চূড়ান্ত আপিল করতে রায়ের কপির অপেক্ষা
পিলখানা ট্র্যাজেডির ১১ বছর
চূড়ান্ত আপিল করতে রায়ের কপির অপেক্ষা

ছবি: ফাইল
বহুল আলোচিত বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডের ১১ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরকে রক্তাক্ত করে বাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য। তাদের হাতে প্রাণ হারান মেধাবী ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন।
এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ম্ফোরক মামলা করা হয়। হত্যা মামলার দুই ধাপ বিচার শেষ হয়েছে বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টে। এখন বাকি আপিল বিভাগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। গত দেড় মাস আগে হাইকোর্টের দেওয়া ২৯ হাজার ৫৬ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। তবে বিশাল রায়ের অনুলিপি না পাওয়ায় রাষ্ট্র এবং আসামিপক্ষ চূড়ান্ত আপিল করতে পারছে না। ফলে উভয়পক্ষের পরবর্তী কার্যক্রমে দেরি হচ্ছে। অপরদিকে বিস্ম্ফোরক মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে নিম্ন আদালতে।
এ নৃশংসতম হত্যা মামলার রায় কার্যকর করতে হলে আপিল বিভাগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পর সকল আইনি প্রক্রিয়া শেষে রিভিউ এবং রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার বিষয়টিও নিষ্পত্তি করতে হবে।
পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ম্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক নবজ্যোতি খিসা। পরে মামলা দুটি নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তর হয়।
এরপর ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর পুরান ঢাকার বকশীবাজার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালত রায়ে বিডিআরের সাবেক ডিএডি তৌহিদসহ ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং বিএনপির সাবেক এমপি নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু (প্রয়াত), স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন। রায়ে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ২৭৭ জনকে খালাস দেন বিচারিক আদালত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ আসামির মধ্যে ১৪ জন পলাতক। এছাড়া বন্দি অবস্থায় তোরাব আলীসহ দুই আসামি মারা গেছেন।
২০১৩ সালের নভেম্বরের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ ঘটনার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ডিএডি তৌহিদসহ ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ডের (ফাঁসি) আদেশ বহাল রাখেন। এ রায়ে ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন এবং ১৯৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন হাইকোর্ট। খালাস পান ৪৯ আসামি। দুই বছরের বেশি সময় পর চলতি বছর ৮ জানুয়ারি ১১ দফা পর্যবেক্ষণসহ হাইকোর্টের ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় (ডেথ রেফারেন্স ও আপিল) প্রকাশিত হয়। বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চের বিচারপতিরা বাংলা ও ইংরেজিতে দেওয়া রায়ে ভিন্ন পর্যবেক্ষণ দেন। রায়ে মামলার প্রেক্ষাপট, ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা ও নৃশংসতার চিত্রও তুলে ধরা হয়।
এদিকে, এ ঘটনায় বিস্ম্ফোরক আইনে করা অপর মামলাটি গত ১১ বছরেও শেষ হয়নি। ১ হাজার ৩৪৫ জনের মধ্যে এ পর্যন্ত ১৪৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। ঢাকার সিনিয়র বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক ইমরুল কায়েশের আদালতে আগামী ৮ মার্চ পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ রয়েছে।
আপিল ফাইলে একজনেরই লাগবে অন্তত ২০ লাখ টাকা! :অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সমকালকে বলেন, পিলখানা হত্যা মামলার বিচারের দুই ধাপ শেষ হয়েছে। হাইকোর্টে দেওয়া আপিলের রায়ের কপি এখনও হাতে পাইনি। একটি রায়ের অনুলিপি (কপি) তুলতে এক লাখ ৭৫ হাজার টাকা লাগবে। এ টাকা কে দেবে? রায়ের কপি পাওয়ার পর যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে খালাসপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে আপিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ঢাকার নিম্ন আদালতে প্রতি মাসে দুই দিন করে বিস্ম্ফোরক মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। আগামী ৮ মার্চ পরবর্তী সাক্ষ্যের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। চলতি বছরেই এ বিস্ম্ফোরক মামলার বিচার কাজ শেষ হবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি। আইনজীবী কাজল বলেন, হাইকোর্টের দেওয়া আপিল রায়ের কপি পেয়েছি। হত্যা মামলায় যারা যারা খালাস পেয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আপিল করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আপিল বিভাগে আসামিপক্ষ মামলা ফাইল করলেই চূড়ান্ত বিচার কার্যক্রম শুরু হবে।
এ মামলার আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, হাইকোর্টের দেওয়া ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার প্রতিটি রায়ের কপি তুলতে ৮ থেকে ৯ লাখ টাকা ব্যয় হবে। একজন গরিব আসামির পক্ষে এই টাকা জোগাড় করা সম্ভব নয়। তাই আসামিদের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ে আবেদন দিয়েছি, যাতে কোর্ট ফি ছাড়াই মামলার নকল (সার্টিফায়েড) কপি সরবরাহ করা হয়। তিনি বলেন, চূড়ান্ত আপিল করতে হলে হাইকোর্টের রায়সহ সব মিলিয়ে প্রায় ৩৬ হাজার পৃষ্ঠা হবে। এ রকম ১৪টি সেট তৈরি করতে হবে। যে জন্য বিশাল অঙ্কের টাকা প্রয়োজন। হাইকোর্টের রায় বড় হওয়ায় আসামিরা অর্থ সংকটে পড়ে গেছে। সকল নিয়ম-কানুন মেনে আপিল ফাইল করতে হলে একজন আসামির পক্ষে কমপক্ষে ২০ লাখ টাকার প্রয়োজন। কোর্ট ফি ছাড়া নকল পাওয়া গেলে ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করা হবে বলে জানান তিনি।
ফিরে দেখা : ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর দরবার হলে ৯৭ সেনা কর্মকর্তাসহ আড়াই হাজারের বেশি সদস্য উপস্থিত ছিলেন। ওই দিন সকালে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের পর বক্তব্য দেন তখনকার বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহম্মেদ। তার বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে হঠাৎ একটি শব্দ হয়। এরপর সেখানে একে একে হত্যা করা হয় ডিজি শাকিল আহম্মেদসহ অনেক সেনা কর্মকর্তাকে। দু'দিন ধরে চলে বিপথগামী বিডিআর সদস্যদের তা ব। পরে সরকারের আহ্বানে তারা আত্মসমর্পণ করেন। কেউ কেউ গোপনে পালিয়ে যান। পরে তাদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মসমর্পণও করেন। পিলখানা ট্র্যাজেডিতে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন।
বিডিআর জওয়ানদের ওই রক্তাক্ত বিদ্রোহের পর ৫৭টি বিদ্রোহের মামলার বিচার হয় বাহিনীর নিজস্ব আদালতে। ২০১৬ সালের ২০ অক্টোবর সদর রাইফেলস ব্যাটালিয়নের ৭২৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। বিদ্রোহের ঘটনায় ১১টি ঢাকার বিশেষ আদালতে ৬ হাজার ৪৬ জওয়ানকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। খালাস পান ১১৫ জন। পিলখানা বিদ্রোহের পর বিডিআরের নাম, লোগো এবং পতাকাও পরিবর্তন করা হয়।
কর্মসূচি : নিহতদের স্মরণে আজ মঙ্গলবার বনানী সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব এবং বিজিবি মহাপরিচালক নিহতদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। আগামীকাল বুধবার বিকেলে বাদ আসর পিলখানার কেন্দ্রীয় মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল আয়োজন করা হয়েছে। এ মাহফিলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি অংশ নেবেন।
এদিকে, আজ মঙ্গলবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে 'পিলখানা হত্যাকাণ্ড :হত্যাকাণ্ডের বিচার ও আমাদের অনুভূতি' শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)। আলোচনা সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এমপি, মুহম্মদ শফিকুর রহমান এমপি, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, পুলিশের সাবেক আইজি একেএম শহীদুল হক, পিআইবির মহাপরিচালক সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদ, নিরাপত্তা বিশ্নেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ, একাত্তর টিভির এডিটর ইন চিফ মোজাম্মেল বাবু, গাজী টেলিভিশনের এডিটর ইন চিফ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, ডিবিসির সম্পাদক জাহেদুল আহসান পিন্টু প্রমুখ উপস্থিত থাকবেন। সভায় সভাপতিত্ব করবেন সংগঠনের সভাপতি কবীর চৌধুরী তন্ময়।
মন্তব্য করুন