করোনাভাইরাস বিস্তৃতির সঙ্গে কাঁচামাল সংকটে বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানার উৎপাদন সংকুচিত হয়ে আসছে। একইভাবে কমে আসছে আমদানিনির্ভর পণ্যের সরবরাহ। ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না এলে কোনো কোনো খাতে উৎপাদন নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়। কিছু পণ্যের সরবরাহে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেবে। অন্যদিকে চীনে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানি পুরোটাই আটকে যেতে পারে। এ ছাড়া চীন থেকে কাঁচামাল এনে পণ্য তৈরি করে অন্যান্য দেশে যে রপ্তানি হয়, তাও ব্যাহত হবে। এ পরিস্থিতিতে দেশের ব্যাংকগুলো সময় মতো ঋণের কিস্তির টাকা পাবে কি-না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
করোনাভাইরাসের প্রভাব সম্পর্কে সম্প্রতি এফবিসিসিআইর কাছে প্রতিবেদন আকারে এমন মতামত জানিয়েছে বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠন। ব্যবসায়ীদের এই আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তা উঠে এসেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনেও। সংস্থাটি এক প্রতিবেদনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, দেশের শিল্প ও বাণিজ্যের ১৪টি খাত করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কয়েকটি খাতের সম্ভাব্য ক্ষতিও তুলে ধরা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। আর সামগ্রিকভাবে কী ক্ষতি হবে তা নির্ণয়ে কাজ চলছে বলে জানানো হয়েছে।
বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীদের আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে এক চিঠিতে বিশেষ নীতি সহায়তা, ঋণ সহায়তা এবং আমদানি দায় পরিশোধে দেরির কারণে কাউকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত না করার উদ্যোগ নিতে সুপারিশ করেছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবকে লেখা অন্য এক চিঠিতে একই দাবি জানিয়েছেন সংস্থাটির মহাসচিব হোসাইন জামিল।
গত বছরের শেষ দিনে চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এরপর থেকে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে এই ভাইরাস। এখন পর্যন্ত ২৯ দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চীনে কারখানা, ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানো হয়েছে। এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যাতায়াত সীমিত করা হয়েছে। চীনের সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এতে অনেকের চেয়ে বেশি চাপে পড়েছে বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশের মোট আমদানির ২৫ শতাংশ আসে চীন থেকে। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ চীন থেকে এক হাজার ৩৮৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। আর ওই বছর দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৮৩ কোটি ডলারের। এই আমদানির মধ্যে বড় অংশ বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল। এর পরিপ্রক্ষিতে গত ৬ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এক সভায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে এফবিসিসিআইর মতামত চান। এরপর এফবিসিসিআই সদস্য ব্যবসায়ী সংগঠনকে চিঠি দিয়ে মতামত জানতে চায়। গতকাল পর্যন্ত ২৫টি বাণিজ্য সংগঠন এফবিসিসিআইকে তাদের মতামত জানিয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনও চীনের সংকটকালীন পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে কী ধরনের প্রভাব পড়ছে তা বিশ্নেষণ করে প্রাথমিক প্রতিবেদন দিয়েছে।
চট্টগ্রাম চেম্বার জানিয়েছে, স্টিল, সিমেন্ট, প্লাস্টিক, ইলেক্ট্রনিক্স ও ওষুধ খাতের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি করা হয়। বর্তমান অবস্থায় পর্যাপ্ত কাঁচামাল সরবরাহের অভাবে দীর্ঘমেয়াদি শিল্পোৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। নতুন এলসি খোলার হার কমে যাওয়ায় আগামীতে আমদানির পরিমাণ আরও অনেক কমে যাবে। এলসি খোলার হার কমে যাওয়ায় ব্যাংকের মুনাফাতেও ঘাটতি দেখা দেবে। আমদানি কমে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ বাজারে অনেক পণ্যের দাম বাড়ছে। বিভিন্ন কেমিক্যাল, রং ইত্যাদি শিল্পে স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত কাঁচামালের দাম বেড়েছে। আদা, রসুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি ভোগ্যপণ্যের দামও বেড়েছে। চীন থেকে যেসব পণ্য আমদানি হয়, তার বিকল্প উৎস জরুরি ভিত্তিতে খুঁজে বের করতে হবে মনে করে চট্টগ্রাম চেম্বার।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে, করোনাভাইরাসের অজুহাতে অস্থির হয়ে উঠেছে নগরীর ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার। এক সপ্তাহের ব্যবধানে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে আদা, রসুন ও পেঁয়াজের দাম। অন্যান্য আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সংগঠনটি। ডিসিসিআই বলেছে, স্টিলের একটি ইউনিয়ন ফিটিংয়ের দাম ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ছিল ১২০ টাকার মধ্যে। ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৬ শতাংশ বেড়ে তা ১৪০ টাকা হয়। একইভাবে আধা মিলিমিটার পুরুত্বের একটি মাঝারি আকারের অ্যালুমিনিয়াম শিটের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে ১৫৩ টাকা থেকে বেড়ে ১৬২ টাকা হয়েছে। ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের দাম বেড়েছে এক হাজার টাকা। চীনে প্রক্রিয়াজাত মাশরুম, বেবিকর্ন, সুইটকর্ন, ওয়েস্টার সস, ফয়েল পেপার, র‌্যাপিং পেপারের দাম বেড়েছে। চশমা শিল্প ও বণিক সমিতি জানিয়েছে, বর্তমানে চীন থেকে আমদানি বন্ধ।
নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএ জানিয়েছে, কিছু বড় প্রতিষ্ঠানের কাছে ক্রেতার অর্ডার অনুসারে সর্বোচ্চ তিন-চার মাসের কাঁচামাল মজুদ থাকলেও বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের কাছে মজুদ কাঁচামাল প্রায় শেষ হওয়ার পথে। এই সুযোগে কাঁচামালের দাম ২০ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়েছে। ফলে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। ক্রেতার সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত মূল্যে পণ্য সরবরাহের চুক্তি বিদ্যমান থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠান ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, তাদের ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের ৪০ ভাগ আসে চীন থেকে। গত দুই মাস ধরে আমদানি বন্ধ। এতে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তৈরি পোশাক দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প খাত। এ খাতের মাধ্যমেই রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসছে। এ খাতের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির বড় অংশই আসে চীন থেকে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে তৈরি পোশাক খাতে ৫০২ কোটি ডলারের কাঁচামাল আমদানি করা হয়। পাশাপাশি বস্ত্র ও পোশাকশিল্পের মেশিনারি ও যন্ত্রাংশের ৪০ শতাংশ আসে চীন থেকে। এ ছাড়া রাসায়নিক দ্রব্য, ইলেকট্রিক্যাল ইক্যুইপমেন্ট, ইলেকট্রনিক্স, ফেব্রিক্স ও সিনথেটিক ইয়ার্ন আমদানি হয়।
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার ও লেদার গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে এই মুহূর্তে চীনে চামড়া রপ্তানি বন্ধ আছে। ইতোমধ্যে তাদের শিল্পে তিন হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। কসমেটিকস ও টয়লেট্রিজ আমদানিকারক সমিতি জানিয়েছে, এ খাতে প্রতি মাসে ২০০ কনটেইনার পণ্য আমদানি হয়। বর্তমানে আমদানি বন্ধ। ইলেকট্রিক্যাল মার্চেন্ডাইজ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, এই খাতের সিংহভাগ পণ্যই আসে চীন থেকে। বর্তমানে আমদানি বন্ধ রয়েছে। জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, তাদের পণ্যের রপ্তানিও বন্ধ। মুদ্রণ শিল্প সমিতি বলেছে, তাদের প্রয়োজনীয় মালপত্র আমদানি হচ্ছে না। মেডিকেল ইনস্ট্রুমেন্ট ও হসপিটাল ইক্যুইপমেন্ট আমদানি কমেছে বলে জানিয়েছে এ খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন। খেলনা উৎপাদকরা জানিয়েছেন, কাঁচামাল পাওয়া যাচ্ছে না। কাঁচামাল বা যন্ত্রাংশ আমদানি করতে না পারলে খেলনা খাতের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি জানিয়েছে, তাদের প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ সরবরাহ কমেছে। এতে কম্পিউটারের দাম বেড়ে যেতে পারে। ইলেকট্রনিক্স মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে- টিভি, ফ্রিজ, মোবাইল ফোন, ওভেন, চার্জারসহ ইলেকট্রনিক্স পণ্যের ৮০ ভাগই আসে চীন থেকে। বর্তমানে শিপমেন্ট বন্ধ আছে। এর ফলে স্থানীয় বাজারে পণ্যের সংকট দেখা দিচ্ছে। ফল ব্যবসায়ীরা বলেছেন, বর্তমানে আমদানি বন্ধ। এর প্রভাব পড়েছে ফলের দামে। কেমিক্যাল ও পারফিউমারি অ্যাসোসিয়েশন বলেছে, তাদের গোডাউন খালি হয়ে এসেছে। নতুন আমদানি সম্ভব হচ্ছে না। পোলট্রি ফিড অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, পোলট্রি ও ফিশ ফিডের আমদানি বন্ধ রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রতি বস্তায় দাম বেড়েছে ২০০ টাকা। লাইভ অ্যান্ড চিল্ড ফুড এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় ব্যবসায়ী ও চাষি উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ইতোমধ্যে ৪০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি জানিয়েছে, তাদের কারখানার প্রয়োজনীয় ইনজেকশন মোল্ডিং, প্রিন্টিং, এক্সটু্রশন ইত্যাদি মেশিনের স্পেয়ার পার্টস চীন থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন :ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তৈরি পোশাকের ওভেন ও নিট উভয় খাতে কাঁচামালের সরবরাহ কমে যাওয়ায় ইতোমধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ফিনিশড লেদার ও লেদার গুডস খাতে রপ্তানি কমছে। এ খাতে তিন হাজার কোটি টাকার সম্ভাব্য ক্ষতি হতে পারে বলে মনে করছে কমিশন। কাঁচামাল না পাওয়ায় গার্মেন্টস এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স শিল্প সংকুচিত হতে পারে বলে মনে করছে কমিশন। এ খাতে সম্ভাব্য ক্ষতি দেড় হাজার কোটি টাকায় ঠেকবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন থেকে প্রসাধন, ইলেকট্রিক্যাল, মুদ্রণ, চশমা, কম্পিউটার যন্ত্রাংশ, ইলেকট্রনিক্স, চিকিৎসা ও প্লাস্টিক খাতের মাল আমদানি বন্ধ রয়েছে। পাট, কাঁকড়া, কুঁচে রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় এসব খাত ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে।