
বিদ্যালয়ের প্রধান ফটক পেরোতেই দেয়ালে চোখে পড়ে মাতৃভাষা দিবসের পোস্টার; কাঁচা হাতে লেখা 'মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা'। মাস দুই আগের বিজয় দিবসের দেয়ালিকা এখনও মলিন হয়নি। তাতে লাল-সবুজে লেখা- 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।'
মনে হতে পারে, স্কুল তো এমনই হয়; তবে অন্যরকমই লাগবে এটা জেনে যে, মরুর দেশ সৌদি আরবের স্কুল এটি। ঊষর মরুতে সবুজের পরশ জাগানো এ স্কুলের নাম মদিনা বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। এমন মোট নয়টি বাংলা স্কুল রয়েছে সেখানে।
সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ্র তথ্যানুযায়ী, প্রায় ২২ লাখ বাংলাদেশি বসবাস করে সেখানে। অনেকেই সপরিবারে প্রবাসী। এদের সন্তানরাই শিক্ষার্থী এসব বাংলা স্কুলের। বাংলাদেশের পাঠ্যক্রম অনুযায়ী তাদের পড়ানো হয় এসব স্কুলে। বিদেশের মাটিতে বাস করেও পিইসি, জেএসসি ও এসএসসির পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নেয়। ভালো ফলও করে।
রাষ্ট্রদূত জানালেন, একসময় জমজমাট থাকলেও স্কুলগুলো অর্থ সংকটে ধুঁকছে এখন। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে সৌদি সরকার বিদেশি নাগরিকদের ওপর নানা রকম কর (রছুম) বসিয়েছে। কর্মক্ষমদের ওয়ার্ক পারমিট (আকামা) নবায়নে মাসে ৮০০ রিয়াল অর্থাৎ প্রায় ১৭ হাজার টাকা কর দিতে হয়। নির্ভরশীলদের জন্য দিতে হয় মাসে মাথা পিছু মাসে ৪০০ রিয়াল কর। এ কারণে অধিকাংশ প্রবাসীই পরিবার পাঠিয়ে দিয়েছেন দেশে। শিক্ষার্থী কমে গেছে স্কুলে। যারা এখনও রয়েছে, শুধু তাদের দেওয়া বেতনে স্কুল চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি দেখা হয় পবিত্র নগরী মদিনার বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র মোহাম্মদ রাকিবের সঙ্গে। স্কুলের পড়াশোনা, সুবিধা ও অসুবিধা সম্পর্কে বলার পর সে হাসতে হাসতে জানাল, প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম হওয়া পাক্কা- কারণ সে-ই তার ক্লাসের একমাত্র ছাত্র। একই অবস্থা দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আবদুর রাজ্জাকের। পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা নেই, তাই নিজেকে যাচাইয়ের উপায়ও নেই। পড়াশোনা কী হচ্ছে, তা নিজেরাই বুঝতে পারছে না তারা।
তারপরও রাজ্জাক ও রাকিবদের একমাত্র আনন্দ, দেশ থেকে হাজার হাজার মাইলে দূরে সৌদি আরবে বাস করেও বাংলায় পড়াশোনা করতে পারছে। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস জানতে পারছে। কিন্তু আর কতদিন পড়তে পারবে, তা নিয়ে সংশয়ে পড়ে গেছে তারা। শিক্ষার্থী ও অর্থ সংকটে ভুগতে থাকা সৌদি আরবের বাংলা স্কুলগুলোর ভবিতব্য ভবিষ্যৎ ছাড়া আর কেউ জানে না।
মদিনা বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে বছর চারেক আগেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪০০-এর মতো। করের চাপে প্রবাসীরা পরিবার দেশে পাঠিয়ে দেওয়ায় কমতে কমতে তা থেমেছে ৬৫-তে এসে। শিক্ষক সংখ্যা ১৯ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে সাতে। তাদেরও বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন বিদ্যালয় পরিচালনাকারীরা।
স্কুলটি ঘুরে দেখা গেল, চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণির ছাত্ররা একসঙ্গে ক্লাস করছে। সাতটি শ্রেণি মিলিয়ে উপস্থিত ছাত্রের সংখ্যা ২১। সবাইকে একসঙ্গে বিজ্ঞান পড়ানো হচ্ছে। আরেক শ্রেণিকক্ষে চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রীদের ক্লাস চলছিল। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস একসঙ্গেই হয়। দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ওমর আবদুল জলিল জানাল, তার প্রায় সব বন্ধুই দেশে চলে গেছে। বন্ধুরা ফিরে আসবে- এমন আশা এখনও ধরে রেখেছে ওমর।
বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক টিএম শহিদুজ্জামান জানালেন, ২২ বছরে মদিনায় আছেন। স্কুল চালাচ্ছেন ১২ বছর ধরে। এত খারাপ অবস্থা আর কখনই হয়নি। গত বছর সরকার দুই দফায় দেড় লাখ রিয়াল দিয়েছিল। তা দিয়ে স্কুলের ভাড়া পরিশোধ করেছিলেন। এ বছর এখনও সরকারি অনুদান পাননি। কবে পাবেন, তা জানেন না। সময়মতো ভাড়া পরিশোধ না করলে তাকে জেলে যেতে হবে।
মদিনা স্কুল থেকে গত বছর ১৫ জন পিইসি পরীক্ষা দিয়ে ১২ জন জিপিএ ৫ পায়। জেএসসি পরীক্ষায় ১৫ জনে সাতজন জিপিএ ৫ পায়। এসএসসি পরীক্ষায় ১৩ জনের মধ্যে তিনজন জিপিএ ৫ পায়। জেএসসি পরীক্ষায় পাসের হার শতভাগ হলেও নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে মাত্র তিনজন। বাকিরা দেশে ফিরে গিয়েছে।
প্রধান শিক্ষক জানালেন, সৌদি আরবের আইন অনুযায়ী কোনো ভবনে এককভাবে বাংলা স্কুল চালানো যাবে না। তার বিদ্যালয় ভবনে সকাল থেকে দুুপুর ২টা পর্যন্ত একটি আরবি স্কুল চলে। বেলা ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলে বাংলা স্কুল। ক্লাস ওয়ানের বাচ্চাদেরও এ কষ্টকর রুটিন মেনে দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত ক্লাস করতে হয়। সকালবেলায় স্কুল চালাতে ভবন ভাড়া যত দিতে হবে, তা দেওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই।
পরিদর্শন বইয়ে দেখা গেল মদিনা বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। পরিদর্শন বইয়ে স্কুলের কার্যক্রমের প্রশংসা করে লিখেছেন তিনি। শিক্ষার্থীরা বারবার অনুরোধ করেছে, দেশে ফিরে শিক্ষামন্ত্রীকে যেন জানাই, তাদের স্কুলের অবস্থা এখন খুবই খারাপ। সহায়তা দরকার।
পবিত্র নগরী মক্কার বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অবস্থা আরও খারাপ। মক্কার পাহাড়ি এলাকার তিনটি বাড়িতে লুকিয়ে চলছে স্কুলের কার্যক্রম। বাসাবাড়ির ড্রইং রুমে চলে ক্লাস। প্রধান পরিচালক আবদুল জব্বার জানান, একটি আরবি স্কুলের ভবন ভাড়া নিয়ে প্রায় ২০ বছর বাংলা স্কুল চালিয়েছেন। তখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৯০০। এখন এ সংখ্যা ৩১১। যে টাকা শিক্ষার্থীদের বেতন থেকে আসে, তা দিয়ে ভবন ভাড়া করে স্কুল চালানো সম্ভব নয়। তাই বাসাবাড়িতে অবৈধভাবে ক্লাস চলছে। মক্কার পুলিশও এটা জানে। কিন্তু মানবিক কারণে কিছু করছে না।
সৌদি আরবের অন্য স্কুলগুলো সরকারের সহায়তা পেলেও মক্কার স্কুলটি এখন পর্যন্ত কোনো সাহায্য পায়নি। রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ্ বলেন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সৌদি আরবে এসেছেন, বলেছেন, 'একজন শিক্ষার্থী মক্কা-মদিনায় থাকলেও বাংলা স্কুল চালাতে হবে।' তারপরও কেন স্কুলগুলো সহায়তা পাচ্ছে না, তা রাষ্ট্রদূত নিজেও জানেন না। তিনি জানালেন, স্কুলগুলো রক্ষায় সহায়তা চেয়ে পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে চিঠি লেখা অব্যাহত রেখেছেন তিনি।
আবদুল জব্বার জানালেন, শিক্ষার্থীপ্রতি তারা ১৫০ থেকে ৩০০ রিয়াল বেতন নেন। প্রবাসী কর্মীদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। তাই অনেক শিক্ষার্থীর বিস্তর বেতন বকেয়া। মানবিক কারণে কাউকে চাপও দেওয়া যায় না। এসব কারণে ২০১৮ সালে স্কুলের কার্যক্রম বন্ধ করে দেন। কিন্তু পরে প্রবাসীদের অনুরোধে ফের চালু করেন। তিনি বললেন, সরকার যদি একটু সহায়তা দেয়, তাহলেই আরবের বুকে বাংলা শিক্ষা টিকে থাকবে।
মসজিদুল হারাম ছুঁয়ে যাওয়া ইব্রাহিম খলিল রোডে বারোয়ারি পণ্যের দোকান চালান কুমিল্লার লাকসামের নাসিম খান। তার ছেলেমেয়ে বাংলা স্কুলের শিক্ষার্থী। তিনি বললেন, স্কুল না থাকলে তার সন্তানরা কোথায় পড়বে? আরবি স্কুলে পড়লে তো বাঙালি হবে না। বাংলাদেশ কী তাও জানবে না।
মন্তব্য করুন