২০১৭ সালের মে মাসের কথা। একদিন সকালে হন্তদন্ত হয়ে বাংলা একাডেমিতে এলেন বৃক্ষাচার্য দ্বিজেন শর্মা। আমাকে ফোন করে নিচে যেতে বললেন। নিচে নেমে দেখি, একাডেমির এনামুল হক ভবনের সামনে তিনটি গাছ রাখা আছে। আমাকে দেখে বললেন, তোমার দেওয়া গাছ তোমার অফিসেই লাগাব। তিনটি গাছের মধ্যে উদাল আর নীলমণিলতা আমি দিয়েছিলাম তাকে, আর বাগানবিলাস তার কাছেই ছিল। মহাসমারোহে লাগানো হলো গাছ তিনটি। দাদা ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ফিরলেন।

তার এমন উচ্ছ্বাস বা অভিব্যক্তির সঙ্গে আমি আগে থেকেই পরিচিত। কোনো একটি লেখা শেষ করে বা প্রিয় কোনো লেখা সম্পাদনা করতে যেমন গুনগুনিয়ে গান ধরতেন! কিন্তু দাদা যতই খোশমেজাজে থাকুন আমি কিছুটা দুশ্চিন্তায় ছিলাম। গাছগুলো টিকে থাকবে কিনা বা থাকলেও কতটুকু পরিচর্যা হবে! উদ্ভিদের প্রাতঃস্মরণীয় দ্বিজেন শর্মা বলে কথা! তিনটি গাছই অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও বেঁচে গেল। প্রায়ই যাওয়া-আসার পথে দেখি, আশ্বস্ত হই। দেখতে দেখতে এলো মাঘ মাস। শীতের দাপটে সব পাতা ঝরে একেবারেই নিঃস্ব উদাল গাছটি। কিন্তু এই হতশ্রী রূপের আড়ালেই লুকিয়ে ছিল তার ঐশ্বর্যের রহস্য। ফাল্গুনের কয়েকটা দিন বাকি থাকতেই পত্রহীন ডালের আগায় দু-এক গুচ্ছ করে ফুল আসতে শুরু করল। বিস্মিত হই! মাত্র চার বছরের ব্যবধানে ফুল? আহা, দাদা বেঁচে থাকলে হয়তো ছুটে আসতেন। এখানেই শেষ নয়, এ বছরের ফাল্গুন আমাদের জন্য আরও আনন্দ নিয়ে এলো। দ্বিজেনদার লাগানো সেই নীলমণিলতায়ও এবারই প্রথম ফুল ফুটল। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফুটল বাগানবিলাসও। এমন স্নিগ্ধ শোভার বাগানবিলাস আগে কখনও দেখিনি বলেই মনে হলো। 

সেদিন দাদা গাছ লাগিয়ে চলে যাওয়ার পর হঠাৎ একটি বিষয় মনে হলো, এত তাড়াহুড়া করে গাছগুলো কেন লাগালেন দাদা? অন্য সময় হলে তিনি আগে আমাকে ফোন করে সময় ঠিক করে তারপর আসতেন। কিসের এত তাড়া ছিল তার। তিনি কি জানতেন, এগুলোই তার জীবদ্দশায় লাগানো শেষ গাছ? হয়তো জানতেন। না হয় এমন আকস্মিকভাবে তাকে কখনও গাছ লাগাতে দেখিনি। সুযোগ পেলেই তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দুর্লভ প্রজাতির গাছ সংগ্রহ করে বাসায় রেখে সযত্নে লালন করতেন। আর অপেক্ষায় থাকতেন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মতো, কখন সুযোগ আসবে গাছটিকে সঠিক জায়গায় রোপণ করার। সারাজীবন তিনি নিভৃতে এ কাজটিই করেছেন। উদ্ভিদ প্রেমের দীপশিখা ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা তার সন্তানসম উদ্ভিদরাজি আমাদের এসব কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে বারবার।