ভোটের উৎসব-আমেজ কিংবা উচ্ছ্বাস নেই। নির্বাচন কমিশনের কড়াকড়িতে পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুনের আধিক্যও চোখে পড়ে না। এর ওপর করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে রয়েছে চরম আতঙ্ক। ফলে শেষ পর্যন্ত ভোটার উপস্থিতি নগণ্যসংখ্যক হবে- এমন আশঙ্কাও রয়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছে, ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচন স্থগিত করা হোক। তবে ভোট আয়োজনের সিদ্ধান্তে অনড় নির্বাচন কমিশন। তারা জানিয়েছে, আগামীকাল শনিবার নির্ধারিত তারিখেই ঢাকা-১০সহ অন্য তিনটি আসনের উপনির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
তবে এই উপনির্বাচনের প্রধান প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল ও প্রার্থীরা এ বিষয়ে মিশ্র মতামত দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ বলছে, সব প্রস্তুতি শেষ হওয়ার পর এই মুহূর্তে ভোটগ্রহণ স্থগিত রাখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তারপরও সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনেরই। তারা যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটিই মেনে নেবে তারা। বিএনপির পক্ষ থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা-১০ আসনসহ পাঁচটি উপনির্বাচন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিত চাওয়া হয়েছে। দলটি বলেছে, এমনিতেই ভোটারদের মধ্যে ভোট দিতে আগ্রহ কম রয়েছে। এর ওপর করোনার প্রভাবে ভোটার উপস্থিতির হার আরও কমে যাবে।
ঢাকা মহানগরীর ধানমন্ডি, কলাবাগান, হাজারীবাগ ও নিউমার্কেট থানা এলাকা নিয়ে গঠিত এই আসনের উপনির্বাচনের সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় শেষ হয়েছে আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচার।
নির্বাচন কমিশন থেকে ২১ মার্চ ঢাকা-১০, গাইবান্ধা-৩ ও বাগেরহাট-৪ আসনের উপনির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়।
ঢাকা-১০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের পদত্যাগে আসনটি শূন্য হয়। অন্যদিকে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ইউনূস আলী সরকারের মৃত্যুতে গাইবান্ধা-৩ এবং মোজাম্মেল হোসেনের মৃত্যুতে বাগেরহাট-৪ আসন শূন্য হয়। তিনটি আসনের মধ্যে ঢাকা-১০ এ ভোটগ্রহণ হবে ইভিএম পদ্ধতিতে, বাকি দুটিতে ব্যালট পেপারে।
গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জরুরি সভা শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে ইসির সিনিয়র সচিব আলমগীর হোসেন জানান, করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ঢাকা-১০, গাইবান্ধা-৩ ও বাগেরহাট-৪ আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কমিশন এ ভোটের বিষয়ে সুবিধা-অসুবিধা দুটি বিষয়ই বিবেচনা করেছে। সুবিধা বেশি মনে হয়েছে বলেই ভোটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে আগামীকাল শনিবার কমিশনের নিয়মিত বৈঠকে ২৯ মার্চ অনুষ্ঠেয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং যশোর-৬ ও বগুড়া-১ আসনের উপনির্বাচন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, যে সময় ঢাকা-১০সহ পাঁচটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়নি। পরে ধীরে ধীরে বিশ্বজুড়ে প্রাণঘাতী রোগটি ছড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশেও নেওয়া হয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। পরে ঢাকা-১০ উপনির্বাচনের প্রার্থী ও নির্বাচন কমিশনের সমঝোতা অনুযায়ী নির্বাচনী প্রচার শুরুর পর জনসমাগম এড়াতে কোনো প্রার্থীই নির্বাচনী জনসভা ও পথসভা কিংবা পাঁচটির বেশি বড় আকারের শোডাউন করেননি। সীমিত গণসংযোগ ও প্রচার-প্রচারণায় প্রার্থীদের সঙ্গে দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের অংশগ্রহণও ছিল নগণ্য।
এ আসনের উপনির্বাচনে মোট ছয়জন প্রার্থী রয়েছেন। তারা হচ্ছেন আওয়ামী লীগের সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বিএনপির শেখ রবিউল আলম রবি, জাতীয় পার্টির হাজি মো. শাহজাহান, বাংলাদেশ মুসলিম লীগের নবাব খাজা আলী হাসান আসকারী, বাংলাদেশ কংগ্রেসের মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলের (পিডিপি) আবদুর রহীম।
সরেজমিন ঢাকা-১০ আসনের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে উপনির্বাচনকে ঘিরে ভোটারদের মধ্যে কোনো উচ্ছ্বাস কিংবা আগ্রহ চোখে পড়েনি। বেশিরভাগ স্থানেই কোনো পোস্টার কিংবা নির্বাচনী প্রচারপত্র দেখা যায়নি। প্রচারণার পুরো সময়জুড়ে কোথাও ব্যানার-ফেস্টুন এবং মাইকিংও ছিল না। অবশ্য নির্বাচন কমিশন থেকেই কেবল ২১টি নির্ধারিত স্পটে পোস্টার লাগাতে বলা হয়েছিল, অলিগলি পোস্টারমুক্ত রাখার নির্দেশনাও ছিল। ব্যানার-ফেস্টুন লাগানো ও মাইকিংয়ে ছিল নিষেধাজ্ঞা। ফলে অন্য নির্বাচনগুলোর মতো ঢাকা-১০ উপনির্বাচনে জমজমাট অবস্থা ছিল না।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী সমন্বয়ক আব্দুর রহমান বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে মাত্র দু'দিন আগে নির্বাচন স্থগিত করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। নির্বাচনে একটি প্রস্তুতি ও অর্থকড়ির ব্যাপার রয়েছে। প্রার্থীরা ভোটারদের দ্বারে গিয়ে ভোট চেয়েছেন, সব প্রস্তুতি শেষ করেছেন। তবে নির্বাচন কমিশনকেই এ বিষয়ে সব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা তাদের বিষয় বিবেচনা করবে। করোনা আতঙ্কে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার আশঙ্কার বিষয়ে তিনি বলেন, এর আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মানুষ যাতে ঠিকমতো ভোট দিতে আসতে পারেন, সেজন্য যানবাহন চলাচল বন্ধ না করার আহ্বানও জানান তিনি।
আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন গণসংযোগকালে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে এসে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, করোনার কারণে সতর্কতার সঙ্গে প্রচারকালে কোনো রকম জনসভা কিংবা পথসভা করেননি তারা। মানুষকে করোনার বিষয়ে সচেতন করেছেন। নির্বাচন বিষয়ে ইসি যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে, প্রার্থী হিসেবে সেগুলো মেনে চলেছেন তারা।
গতকাল বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পাঁচ আসনের উপনির্বাচন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিতের দাবি জানিয়ে বলেছেন, করোনা আতঙ্কের কারণে জনগণ ও বিভিন্ন জায়গা থেকে নির্বাচন বন্ধ করার দাবি এসেছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা একপেশে ও জনগণের সঙ্গে সম্পর্কবিবর্জিত। জনগণের আশা-প্রত্যাশা- এ দুর্যোগের সময়ে কমিশন মানবিক আচরণ করবে; কিন্তু তারা অমানবিক আচরণ করছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা-১০ আসনের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সমকালকে বলেছেন, করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্তে প্রমাণ হয়েছে জনগণের প্রতি নির্বাচন কমিশনের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। কারণ ইভিএমে একাধিক ব্যক্তির হাতের ছাপ পড়ার কারণে করোনা আর ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। যার দায়দায়িত্ব কমিশনকেই নিতে হবে।
তবে নির্বাচন কমিশনের জরুরি সভা শেষে গতকালের সংবাদ সম্মেলনে ইসির সিনিয়র সচিব আলমগীর হোসেন বলেছেন, সরকার এখনও করোনাকে দুর্যোগ ঘোষণা করেনি, বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি মহামারি আকারও ধারণ করেনি। গণমাধ্যমের তথ্যমতে ভোটার উপস্থিতিও কম হবে। এসব কারণে শনিবারের উপনির্বাচনে স্বাস্থ্যঝুঁকি হবে না বলে মনে করছি।
করোনা সংকটের কারণে ভোটগ্রহণকালে সব ভোটকেন্দ্রে হ্যান্ড স্যানিটাইজেশনসহ স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় সবধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, যেহেতু ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে উপস্থিতি কম ছিল এবং এরই মধ্যে করোনা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সে হিসেবে ভোটার উপস্থিতি কম হবে বলেই মনে করছেন তারা। তবে আইন অনুযায়ী কোনো নির্বাচনে একজন ভোটারও ভোটাধিকার প্রয়োগ করলে নির্বাচন বৈধ হবে। যিনি সর্বোচ্চ ভোট পাবেন, সে প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণাও করতে হবে। সদ্য বিদেশফেরত ভোটারদের ভোট দিতে নিষেধ না করা হলেও ভোটকেন্দ্রে আসতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে এবং আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তিসহ সবধরনের এনআইডি সেবা বন্ধ থাকবে বলেও জানান ইসি সচিব।