
অ্যাঞ্জেল শেফ বেকারিতে কাজ করছেন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা- সংগৃহীত
আট হাজার টাকা বেতনে চাকরি করছেন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ২৫ বছর বয়সী ইনজামাম। দুই ভাইবোনের মধ্যে সে বড়। মা-বাবাকে নিয়ে বর্তমানে মিরপুরের তালতলায় থাকেন। সংসারের খরচের একটা অংশ এই ইনজামামই দেন। অথচ শৈশবে যখন তার মা-বাবা জানতে পারেন, তাদের বড় সন্তান বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, ভেঙে পড়েন তারা। লোকচক্ষুর ভয়ে সন্তানকে ঘর থেকে বের হতে দিতেন না। সেই ইনজামামই আজ 'অ্যাঞ্জেল শেফ' বেকারিতে 'বেকারি অ্যাসিস্ট্যান্ট' হিসেবে কাজ করছেন।
আরেকজন 'সেরিব্রাল পলসি' আক্রান্ত শাহারিয়ার হাসান সাবিথ। বয়স ২২ বছর। বাবা ব্যবসায়ী মুক্তার উদ্দিন ও মা শাহানা খান। তাদের দুই সন্তানের মধ্যে সাবিথ ছোট। প্রতিবন্ধিতার কারণে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পেরেছেন তিনি। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সমাজব্যবস্থার কারণে পড়ালেখার গণ্ডি পার করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি তার। তবে নিজের ইচ্ছাশক্তি ও পরিবারের সহযোগিতায় পিএফডিএ-ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার ট্রাস্টের 'অ্যাঞ্জেল শেফ' বেকারিতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ক্যাটারিং ও প্যাকেজিংয়ে পারদর্শী তিনি। সাবিথ জানান, প্রশিক্ষণ শেষে নিজেই বেকারির ওপর ব্যবসা করবেন।
ইনজামাম ও সাবিথের মতো রাজধানীর গুলশান-১-এর সুপারস্টোর রিটেইল চেইন 'স্বপ্ন'-এর অ্যাঞ্জেল শেফে আরও ১৭ জন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তি কর্মরত। বাংলাদেশে করোনার প্রাদুর্ভাব ছড়ানোর আগে সরেজমিন দেখা যায়, ক্রেতার চাহিদা অনুসারে তারা খাবার সরবরাহ করছেন। তবে সাধারণ মানুষের কাজের গতির তুলনায় তাদের কাজ বা ক্রেতার প্রয়োজনীয় খাবারের অর্ডার বুঝতে সময় লাগে। নতুন ক্রেতারা প্রথম দিকে বিরক্ত বোধ করলেও পরক্ষণেই তারা বুঝতে পারেন, তাদের মধ্যে অস্বাভাবিকতা রয়েছে। ওদের গায়ের অ্যাপ্রোনে লেখা- 'ডিফারেন্টলি অ্যাবল, নট ডিজঅ্যাবল'। তারা আসলে অন্যরকম, অন্য সবার মতো নন। তাদের মধ্যে কেউ শারীরিক, কেউ বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বা অটিস্টিক, বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধীসহ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তি। তাদের পরিচালনায় স্বপ্নের ফুড সার্ভিস আউটলেট 'অ্যাঞ্জেল শেফ' চলছে।
ওই সময় দেখা যায়, যে ক্রেতা মাছের আকৃতির 'চিকেন ফিশ' নিতে গিয়ে চরম বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন, তিনিই অ্যাঞ্জেল শেফে যারা কাজ করছেন, তাদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। কেউ কেউ নিয়মিতই আসেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ক্রেতা বলেন, 'আমি এখানে নিয়মিত আসি। খাবার কিনি। কিন্তু তারা কোনো না কোনো প্রতিবন্ধকতার শিকার, তা মনে করিয়ে দিই না। সবারই এ কাজটা করা উচিত।' আরেক নারী ক্রেতাও জানালেন, তার এক সন্তান অটিস্টিক। এখানে এলে তিনি মনে সাহস পান যে, তার ছেলেও ভবিষ্যতে কোনো না কোনো কাজ করতে পারবে। আর এখানকার খাবারের মান খুব ভালো।
অ্যাঞ্জেল শেফের অটিস্টিক হিশাম, ডাউন সিনড্রোমের দোলন ও বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধী লিজা কাজ করেন। তাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব ভিন্ন। কেউ ক্রেতা আসামাত্রই যে জিনিসটি চাইলেন, তার দাম কত, ক্রেতা কত দিলেন, আবার ক্রেতাকে কত ফেরত দিতে হবে, তা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। অন্যদিকে যে ক্রেতারা সেখানে বসেই খাবার খাচ্ছেন, তাদের খাবার দেওয়া এবং খাওয়া শেষে জায়গাটি পরিষ্কারের কাজ করেন আরেকজন। তাদের মধ্যে লিজা ইশারা ভাষায় ক্রেতাদের খাবার খেয়ে দেখার আমন্ত্রণ জানান।
বেকারি ও পেস্ট্র্রি শপটিতে বাকিরা ময়দা মাখানো, চুলা জ্বালানোসহ অন্যান্য কাজে ব্যস্ত। 'অ্যাঞ্জেল শেফ' আউটলেটটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক অটিস্টিকসহ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণের জন্য গঠিত পিএফডিএ-ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারের চেয়ারম্যান সানজিদা রহমান ড্যানি। তিনি সমকালকে জানান, অ্যাঞ্জেল শেফ বেকারি প্রতিবন্ধিতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত। তাদের মূলধারার কর্মসংস্থানে সম্পৃক্ত করতেই দেশে প্রথম 'অ্যাঞ্জেল শেফ' কাজ শুরু করে। ২০১৫ সালে বেকারি ও ফুড সার্ভিসের ওপর প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর অ্যাঞ্জেল শেফ যাত্রা শুরু করে। এখন পর্যন্ত 'অ্যাঞ্জেল শেফ' একটি প্রোডাকশন সেন্টার, একটি 'হট কিচেন' ও ৯টি আউটলেট পরিচালনা করছে, যেখানে ১৭ জন প্রতিবন্ধিতাসম্পন্ন ব্যক্তি কাজ করছেন। এ ছাড়া এতে শ্রম আইন মানা হচ্ছে। ১৮ বছরের কম বয়সীদের এখানে কাজ দেওয়া হয় না। শ্রমঘণ্টাও মানা হয়। কাজের ভিত্তিতে ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারের পক্ষ থেকে একেকজনকে পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন দেওয়া হচ্ছে। কেউ কেউ প্রশিক্ষণার্থী হিসেবেও কাজ শেখেন। দুই শিফটে তারা কাজ করেন, সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। তবে সবকিছু গুছিয়ে, পরিষ্কার করে বের হতে হতে ১০টা বেজে যায়। বেশিরভাগ ব্যক্তির বেতন চলে যায় তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে।
তিনি বলেন, 'বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমাজের মূল স্রোতে আনতে হলে তাদের মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ দিতে হবে। এই ব্যক্তিরা কোনো কাজ করতে পারে না- মানুষের এই ভুল ধারণাও পাল্টাতে হবে। এই ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্য, বিশেষ করে মা-বাবা মনে সাহস পাচ্ছেন যে, তাদের অনুপস্থিতিতে তাদের সন্তান হয়তো কিছু না কিছু করে জীবন চালাতে পারবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, এই ব্যক্তিদের যদি শেখানো হয় কোনো খাবারে ঘি লাগবে, তবে ওই খাবার বানাতে ঘি ছাড়া তারা কোনো অবস্থাতেই তেল দেবেন না বা কোনো আপস করবেন না।'
সানজিদা রহমান প্যারেন্টস ফোরাম ফর দ্য পারসনস উইথ অটিজম, সেরিব্রাল পলসি, ডাউন সিনড্রোমস, ইন্টেলেকচুয়াল অ্যান্ড নিউরোলজিক্যাল ডিজঅ্যাবিলিটিসের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার নিজের একমাত্র সন্তান অটিস্টিক। সানজিদা রহমান বিভিন্ন জায়গায় অ্যাঞ্জেল শেফের আদলে আউটলেট গড়ে তুলতে সরকার এবং 'স্বপ্ন'র মতো অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ৩০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাঞ্জেল শেফের উদ্বোধন করেন অভিনেতা আরিফিন শুভ। অ্যাঞ্জেল শেফে আছে উন্মুক্ত রান্নাঘর। ক্রেতাদের সামনেই খাবার প্রস্তুত ও রান্না হয়। ক্রেতারা চাইলে সেখানে না খেয়ে খাবারের প্যাকেট নিয়েও যেতে পারেন। খাবার বানানোর বিভিন্ন কাঁচামালসহ অন্যান্য জিনিস স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পিএফডিএ-ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার থেকে পাঠানো হচ্ছে।
মন্তব্য করুন