রাজধানীর পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ঘিরিঙ্গি মোড় সংলগ্ন একটি টিনশেড ভবনে মাসিক চার হাজার টাকা ভাড়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকেন পঞ্চাশোর্ধ্ব ইউসুফ বেপারী। ভ্যানগাড়ি চালান তিনি। একজন সহযোগী নিয়ে রোকেয়া সরণির ফার্নিচারের দোকানগুলোর বিক্রীত ফার্নিচার ভ্যানগাড়িতে করে ক্রেতার বাড়িতে পৌঁছে দেন। ভ্যান মালিককে জমার টাকা দিয়েও প্রতিদিন ৬০০ থেকে হাজার টাকা পকেটে থাকে। করোনাভাইরাসের মহামারি শুরুর পর রোকেয়া সরণির দোকানপাট বন্ধ; তার আয়ও বন্ধ। হাতে জমানো সামান্য টাকা-পয়সাও নেই। ধারদেনা করে চেয়েচিন্তে কোনো রকমে সংসার চালাচ্ছেন। ইতোমধ্যে আরেকটা মাস শুরু হয়েছে। কিন্তু বাসা ভাড়া দেওয়ার মতো অবস্থা নেই। ভ্যান নিয়ে রাস্তার পাশে বসে থাকেন। কোনো খেপ পান না। ইউসুফ বেপারী বলেন, বাসা ভাড়া দেবো কীভাবে? পেটই তো চলে না! এদিকে ১০ তারিখের মধ্যে বাসা ভাড়া দেওয়ার কথা। এ মাসে হয়তো বাসা ভাড়া দিতে পারবেন না। আর বাসা ভাড়া না দিলে মালিক তাকে বাসা ছেড়ে দিতে বলবেন কিনা, তা নিয়েও শঙ্কায় আছেন।

কেবল ইউসুফ বেপারীই নন; তার মতো অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ এখন একই সমস্যায় ভুগছেন। কীভাবে বাসা ভাড়া দেবেন, বুঝতে পারছেন না। গ্রামে চলে যাবেন, তারও উপায় নেই। কাজকর্ম বন্ধ হওয়ার পর চোখে অন্ধকার দেখছেন। সন্তানদের মুখে কীভাবে খাবার তুলে দেবেন, সামনের দিনগুলো কীভাবে চলবেন তা চিন্তা করে এখন দিশেহারা। এ অবস্থায় তাদের বাড়ির মালিকরা যদি বাসা ভাড়া মওকুফ করেন তাহলে হয়তো কোনোভাবে বাঁচতে পারবেন। অন্যথায় পথে নামা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এ প্রসঙ্গে সমকালকে বলেন, এই পরিস্থিতিতে বাড়িওয়ালারা চাইলে নিম্ন আয়ের মানুষের দুই মাসের ভাড়ার ৫০ থেকে শতভাগ মওকুফ করে দিতে পারেন। কিন্তু অনেক বাড়িওয়ালা আছেন, যাদের বাড়ি ভাড়ার ওপর নির্ভর করে সংসার চলে। অনেকে ঘরবাড়ি বানানোর সময় ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। ভাড়ার টাকা দিয়ে তারা ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করেন। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের কাছে বাড়ি মালিকদের তথ্য থাকে। যেসব বাড়ি মালিকের ব্যাংক ঋণ আছে তাদের হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাড়ি মালিকরা সহজেই ভাড়াটিয়াদের এক-দু'মাসের ভাড়া মওকুফ করে দিতে পারবেন। গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, ঢাকা শহরে প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ বস্তিতে বসবাস করে। এর মধ্যে কিছু ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে  গড়ে ওঠা, আর কিছু আছে সরকারি জমিতে। সরকারি জমির বস্তিগুলোতে সরকার কোনো ভাড়া না পেলেও সেখানে প্রভাবশালী একটি চক্র বস্তিবাসীর কাছ থেকে ভাড়া তোলে। সরকার চাইলে ওই বস্তিবাসীর ভাড়া মওকুফের ব্যবস্থা সহজেই করতে পারে। আর ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে গড়ে ওঠা বস্তিমালিকদের প্রতি আহ্বান জানাতে পারে ভাড়া মওকুফের।

অবশ্য মধ্য পীরেরবাগ বাড়ি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শফিউল্লাহ বাবু বলেন, অনেকে টিনশেড বানিয়ে নিজে দুইটা রুমে থাকে। অন্য চারটা রুম ভাড়া দেয়। সেই টাকা দিয়ে তার সংসার চলে। সরকার এত প্রণোদনা প্যাকেজ দেয়। কিন্তু গরিব মানুষ তো কোনো প্যাকেজ পায় না। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সরকার একটি প্রণোদনা প্যাকেজ দিতে পারে। তিনি বলেন, তার এলাকার কোনো ভাড়াটিয়া এখন পর্যন্ত তার কাছে ভাড়া মওকুফের দাবি নিয়ে যাননি। গেলে তিনি ওই বাড়ি মালিককে অনুরোধ করবেন যতদূর সম্ভব ভাড়া মওকুফ করার। ইতোমধ্যে নিজ উদ্যোগে এলাকার গরিব মানুষের বিনামূল্যে খাবার বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। এ কাজে এলাকার বাড়ি মালিকদেরও অনুরোধ করছেন বলে জানান।

পীরেরবাগ রোডে বাড়ির মালিক আবু তাহের বলেন, ইতোমধ্যে শেওড়াপাড়া এলাকার বাড়ি মালিকদের কল্যাণ সমিতির উদ্যোগে প্রত্যেক বাড়ির মালিকের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা তোলা হচ্ছে। ওই টাকা এলাকার গরিব মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের (কামরাঙ্গীরচর এলাকা) কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন বলেন, তার ওয়ার্ডে নিম্ন আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ভাড়াটিয়ারা সাধারণত ৫ থেকে ১০ তারিখের মধ্যে ভাড়া দেয়। এখন পর্যন্ত কোনো বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়াদের চাপ দেননি। কোনো ভাড়াটিয়াও অভিযোগ নিয়ে তার কাছে যাননি। যদি কোনো ভাড়াটিয়া ভাড়া মওকুফের দাবি নিয়ে তার কাছে যান, তখন তিনি বাড়ির মালিককে ৭০ শতাংশ ভাড়া মওকুফের অনুরোধ করবেন। তিনি জানান, ইতোমধ্যে তার ওয়ার্ডের দুই হাজার ৪৫০ জন দরিদ্র মানুষের তালিকা তৈরি করেছেন। ২ এপ্রিল তিনি তাদের মধ্যে বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করবেন। এমন পরিস্থিতিতে বাড়ির মালিকদের অনুরোধ করলে বেশিরভাগ বাড়িওয়ালাই অনুরোধ শুনবেন বলে তার আশা।

এদিকে দেশের চলমান পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের ভাড়াটিয়াদের দুই মাসের ভাড়া মওকুফের দাবি বেশ জোরালো হচ্ছে। সম্প্রতি সিলেট মহানগরের ২৭টি ওয়ার্ডের ভাড়াটিয়াদের এক মাসের বাসা ভাড়া মওকুফের জন?্য বাড়িওয়ালাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক। পাশাপাশি তিনি দেশের সব মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যানদেরও এই প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠানোর অনুরোধ করেছেন। ভাড়া মওকুফের তালিকা থেকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, জনপ্রতিনিধি ও প্রতিষ্ঠিত বযবসায়ীদের বাদ দেওয়ার অনুরোধ করেছেন তিনি। এ বিষয়ে একটি প্রস্তাবও তিনি মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন বলে উল্লেখ করেন।

গত ৩১ মার্চ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র আতিকুল ইসলামও রাজধানীর নিম্ন আয়ের মানুষের বাসা ভাড়া মওকুফের জন্য নগরবাসীর প্রতি অনুরোধ জানান। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও সচ্ছল বাড়ি মালিকদের অনুরোধ জানিয়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষের বাসা ভাড়া মওকুফের।

ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, বর্তমান অবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের বাসা ভাড়া পরিশোধ করার কোনো সক্ষমতা নেই। তাদের তিন বেলা খাবারের নিশ্চয়তাও কঠিন। ডিএনসিসির পক্ষ থেকে নিম্ন আয়ের মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় বাড়ির মালিকদের অনুরোধ করব, তারা যেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত নিম্ন আয়ের মানুষের বাসা ভাড়াটা মওকুফ করে দেন।

এদিকে করোনা সংকটের পরপরই জুরাইনের বাসিন্দা ব্যবসায়ী শেখ শিউলি হাবিব স্বেচ্ছায় তার ভাড়াটিয়াদের মার্চ মাসের ভাড়া মওকুফের ঘোষণা দেন। দেশের এই দুর্যোগকালে শেখ শিউলী হাবিব তার স্বামীর উৎসাহে নিম্নবিত্ত ভাড়াটিয়াদের এক মাসের ভাড়া মওকুফ করে মানবতার যে নজির স্থাপন করেছেন, তা ভূয়সী প্রশংসা পায়। তার বিষয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সাংবাদিক আশীষ কুমার দে বলেন, 'প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গোটা বিশ্ব হিমশিম খাচ্ছে। নিম্নবিত্তসহ শ্রমজীবী মানুষের আয়ের পথ অনেকটা রুদ্ধ। তাদের জীবন-জীবিকা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ সরকারও পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশেষ করে মানুষের জীবন রক্ষায় একের পর এক শক্ত পদক্ষেপ নিচ্ছে। ঠিক এই সময়ে শিউলী হাবিবের এই মহানুভবতার খবর জেনে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য শহরের বাড়িওয়ালারা এবং সমাজের বিত্তবানরাও জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে মানবিক মূল্যবোধের পরিচয় দেবেন বলে প্রত্যাশা করি।'

শিউলী হাবিবের ঘোষণার পরপরই আরও দুই বাড়িওয়ালা বাসা ভাড়া মওকুফের ঘোষণা দেন। হাজারীবাগ বেড়িবাঁধের বাসিন্দা মুহিবুর রহমান এবং চলচ্চিত্র অভিনেত্রী আশনা হাবিব ভাবনার বাবা হাজারীবাগের বাসিন্দা হাবিবুল ইসলাম হাবিব তাদের ভাড়াটিয়াদের দুই মাসের ভাড়া মওকুফের ঘোষণা দেন। এই ঘোষণাও সুধীজনের কাছে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে কেবল নিম্ন আয়ের মানুষই নয়; নিম্ন-মধ্যবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্তের মানুষও সংকটে পড়তে পারেন। কারণ নিম্ন আয়ের মানুষ সাবলীলভাবেই ত্রাণের জন্য লাইনে দাঁড়াতে পারবেন। প্রয়োজনে কারও কাছে কিছু চাইতে পারবেন। কিন্তু নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষ লাইনে দাঁড়াতে সংকোচ বোধ করেন। ভেতরে ভেতরে এ শ্রেণির মানুষও সংকটে পড়তে যাচ্ছেন।

তিন মাসের ভাড়া মওকুফের দাবি ভাড়াটিয়া পরিষদের :করোনা সংকটের কারণে তিন মাসের বাড়ি ভাড়া মওকুফের দাবি জানিয়েছে ভাড়াটিয়া পরিষদ। সংগঠনটি গতকাল বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেছে, করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউন চলায় দেশের অধিকাংশ মানুষ কাজ করতে পারছে না, বাইরে বের হতে পারছে না। রাজধানীসহ সারাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। যে শ্রমিকরা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করতেন তারা বেকার হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে দেখা দিয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। একদিকে করোনাভাইরাস আতঙ্ক, অন্যদিকে অর্থাভাব। এতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এ পরিস্থিতিতে এপ্রিল, মে, জুন এ তিন মাসের ভাড়াসহ বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ও ট্যাক্স মওকুফ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী আদেশ জারির দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।