করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মৃত্যুর হারের দিক থেকে এ সময়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে- ইতালির পরেই বাংলাদেশ। ৫০-এর ঊর্ধ্বে মারা গেছেন, এই হারে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম অবস্থানে। করোনায় চিকিৎসাটা খুব জরুরি, যদিও ৮২ শতাংশ লোক বাসা থেকে চিকিৎসা নিয়েই ভালো হয়ে যায়। এ সংক্রমণে বয়স্ক মানুষের মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে করোনায় আক্রান্ত একজনও মারা যায়নি।
এই অঞ্চলে শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সবচেয়ে ভালো। আর যে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যত ভালো সে দেশে মৃত্যুর হার তত কম হবে। ট্রাম্প একটা কথা বলেছেন- তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা করোনা মহামারির সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত নয়। এর মানে যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও মৃত্যু কমাতে পারেনি। করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিশেষ প্রস্তুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যত আগাম প্রস্তুতি নেব, মৃত্যুঝুঁকিতে থাকা মানুষগুলোকে তত দ্রুত বাঁচাতে পারব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের এ বছরের থিম- 'নার্স ও ধাত্রীদের সহযোগিতা করুন।' একটি দেশে স্বাস্থ্যসেবায় স্বাস্থকর্মীদের অনুপাত হওয়া উচিত ১:৩:৫। অর্থাৎ একজন ডাক্তারের সঙ্গে তিনজন নার্স ও পাঁচজন প্যারামেডিক থাকা মানসম্মত। জনবল এই অনুপাতে থাকলে ভালো স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে নার্স আর ডাক্তারের অনুপাত উল্টো, এখানে তিনজন ডাক্তারের বিপরীতে একজন নার্স নেই। নার্স কম থাকায় বাংলাদেশে আমরা ভালো স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারি না। আমাদের নার্সের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মান ভালো হতে হবে। এখানে নার্সদের প্রশিক্ষণের গুণগত মান উন্নত করা প্রয়োজন। এ জন্য প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যেমন বাড়তে হবে, তেমনি নার্সদের প্রশিক্ষণ কারিকুলামে পরিবর্তন আনতে হবে এবং আধুনিকায়নও করতে হবে- যাতে তারা বর্তমান সময়ের রোগব্যাধি সম্পর্কে জানতে পারে। নার্সদের যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। কারণ বর্তমানে কভিড-১৯, সার্স, মার্সের মতো প্রাণঘাতী রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। এগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি থাকতে হবে।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস বিস্তারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অগ্রভাগে থাকার কথা ডাক্তার ও নার্সদের। সুতরাং তাদের আধুনিক প্রশিক্ষণ জরুরি। করোনা সংক্রমণে বাংলাদেশে শতভাগ সিনিয়র সিটিজেনের মৃত্যু হয়েছে। যারা মারা গেছেন তাদের সবার বয়স ৫০-এর ওপরে। তাই প্রবীণদের চিকিৎসাসেবার প্রস্তুতি আরও শক্তিশালী করে মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে হবে। করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবার জন্য প্রয়োজন আইসোলেশন, ভেন্টিলেটর এবং অক্সিজেন। বয়স্ক রোগীদের অনেকেই সচরাচর ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনির সমস্যা, লিভারে সমস্যা, অ্যাজমাসহ নানা রোগে ভোগেন। তাদের যদি শ্বাসের সমস্যা হয়, তাহলে মৃত্যুর ঝুঁকিও বেড়ে যায়। এদের চিকিৎসায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স ও ডাক্তার প্রয়োজন। আইসোলেশন ও আইসিইউ ব্যবস্থাপনা ও ভেন্টিলেশনের কাজ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্সরা করে থাকেন। আমাদের নার্সের সংখ্যা কম, আইসিইউ নার্স সংখ্যা আরও কম। এ জন্য আমাদের জরুরি ভিত্তিতে প্রচুর সংখ্যক নার্সকে আইসোলেশন, আইসিউই ও ভেন্টিলেশন সেবার জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
এ পরিস্থিতিতে জেলায় জেলায় কভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রস্তুত করতে হবে। এই হাসপাতালগুলোয় পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার ও নার্স থাকতে হবে। সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে যে এক হাজার ১৭৪টি আইসিইউ বেড রয়েছে, সেগুলো করোনা চিকিৎসার বিশেষায়িত হাসপাতালের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। আইসিইউ সংশ্নিষ্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্সদের এসব হাসপাতালে নিয়োগ দিতে হবে। এদের মাধ্যমে আরও প্রচুর সংখ্যক নার্সকে আইসিইউ ও ভেন্টিলেশন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তারা কভিড-১৯ রোগীদের দক্ষতার সঙ্গে সেবা দিতে পারেন। মৃত্যুর হার কমাতে এর বিকল্প নেই। সরকারকে প্রচুর ভেন্টিলেটর দ্রুত বিদেশ থেকে আনতে হবে। আইসিইউ বেডের সংখ্যা দ্রুত বাড়াতে হবে। করোনা চিকিৎসাসেবার জন্য আরও নার্সকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশের মতো এ দেশেও করোনায় চিকিৎসাসেবায় যুক্ত ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষ প্রণোদনা দিতে হবে।
চিকিৎসাসেবার মান বাড়ালেই আমরা মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে পারব। আমাদের যে মৃত্যুহার, তা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য চ্যালেঞ্জ। এখন দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সুষম, শক্তিশালী ও কার্যকর করে তুলতে হবে। কভিড-১৯ সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরীক্ষার ওপর জোর দিলেও বাংলাদেশে এই হার অনেক কম। পরীক্ষার স্থিতি বাড়াতে হবে- কিন্তু কিটের সংখ্যা কম। তাই আমরা র‌্যাপিড ডায়াগনস্টিক টেস্ট করতে পারি। যাদের এই ফলাফল পজিটিভ হবে তাদের পিসিআর কিট দিয়ে পরীক্ষা করে কভিড-১৯ সংক্রমণের বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারি। তাই পিসিআর কিটের জন্য অপেক্ষা না করে উপজেলা পর্যায়েও যে হেলথ টেকেনোলজিস্টরা আছেন, তাদের স্বল্প প্রশিক্ষণ দিয়ে স্ট্ক্রিনিং টেস্ট করা যায়। এদের সঙ্গে নার্স ও প্যারামেডিক্সদের যুক্ত করা যেতে পারে। পাশাপাশি হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিদের জন্য উপজেলা পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন গড়ে তোলা প্রয়োজন। এরপর তাদের স্ট্ক্রিনিং করে যাদের করোনা পজিটিভ আসবে তাদের আইসোলেশনে রাখতে হবে। যদি কোনো উপজেলায় পরীক্ষায় কভিড-১৯ রোগী পাওয়া না যায়, তাহলে ওই উপজেলাকে করোনামুক্ত ঘোষণা করে পুরো উপজেলা লকডাউন করা যেতে পারে, যাতে কেউ ঢুকতে বা কেউ বেরুতে না পারে। এভাবে পর্যায়ক্রমে জেলাগুলো করোনামুক্ত ঘোষণা করা যাবে। যেমন গাইবান্ধায় করোনার সংক্রমণ পাওয়া গেলেও উত্তরের অন্য জেলাগুলোতে কভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়নি। ফলে অন্য জেলাগুলো লকডাউন করলে সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব।