
করোনার কালো থাবায় বিপর্যস্ত জনজীবন। বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ দিন দিন বাড়ছে। ভালো নেই পাহাড় ও সমতলের প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরাও। দেশজুড়ে চলমান গণছুটি ও লকডাউনের কারণে দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করা দরিদ্র এই মানুষগুলো পড়েছে চরম খাদ্য সংকটে। আদিবাসী পরিবারগুলোতে এখনও সরকারি বা বেসরকারি ত্রাণ সহায়তা পৌঁছেনি।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, দেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৪০ লাখের বেশি। এদের অধিকাংশই গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষ। পাহাড় ও সমতলের প্রান্তিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কয়েক লাখ পরিবার সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের ত্রাণ সহায়তার বাইরে রয়ে গেছে।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদ ও কাপেং ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, শেরপুরের নালিতাবাড়ী, ময়মনসিংহের ধোবাউড়া, নেত্রকোনার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা ও সুনামগঞ্জের মধ্যনগর ও তাহিরপুর থানার বিভিন্ন হাজং ও বানাই গ্রামের শতাধিক পরিবারে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের আদিবাসীরাও খাদ্য সংকটে পড়েছে।
আদিবাসী পরিষদের নেতারা জানান, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলায় ৩৮টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ১৫ লাখ সদস্যের বসবাস। এদের মধ্যে রয়েছে সাঁওতাল, ওঁরাও, মুণ্ডা, মাহাতো (বেদিয়া/কুড়মি), মালো, মাহালে, মুষহর, কড়া, কোডা, কোল, ভিল, ভুঁইমালি, বাগদী, তুরি, গঞ্জু, গড়াইত, তেলি, কোচ, কন্দ, রাজোয়াড়, লোহার, শবর, হো ইত্যাদি। এসব জাতিসত্তার ৯০ শতাংশই বর্তমানে ভূমিহীন। তাদের জীবন চলে দিনমজুরির টাকায়। অন্যের কৃষি জমিতে নিড়ানি, সার-লাগানো, চারা পরিচর্যা ইত্যাদি কাজ করেই তারা জীবিকা নির্বাহ করে। নিত্যদিনের আয়ে চাল, ডাল, তেল, লবণ কিনে তারা বাড়ি ফেরে। করোনা মহামারিতে দেশজুড়ে চলমান লকডাউন পরিস্থিতিতে তারা হয়ে পড়েছে কর্মহীন। এতে এসব প্রান্তিক মানুষ জংলী আলু, কচুশাক, শামুক, ঝিনুক, কুঁচিয়া ও কাঁকড়া সংগ্রহ করে খাবার চাহিদা মেটাচ্ছে। অনেক আদিবাসী কৃষি শ্রমিক ইতোমধ্যে চড়া সুদে মহাজনের কাছ থেকে দাদন বা আগাম শ্রম বিক্রি করছে। কেউ কেউ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করেছে। তারা নামমাত্র অর্থে আগাম বোরো ধান কাটার চুক্তিতে আবদ্ধ হচ্ছে, যা নিম্ন আয়ের এসব মানুষের জন্য আত্মঘাতী। কারণ মৌসুমের ফসল ওঠামাত্রই মহাজন ও চাল ব্যবসায়ীরা দ্বিগুণ ও তিনগুণ দরে সেই কর্জ সুদে-আসলে আদায় করবে। এতে করে আদিবাসীরা দিন দিন আরও নিঃস্ব ও অসহায় হয়ে পড়বে।
কাপেং ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, গাইবান্ধায় প্রায় ১২০০ সাঁওতাল পরিবার ও রাজশাহীতে দুই হাজার সাঁওতাল, পাহাড়িয়া ও ওঁরাও পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে।
সূত্রমতে, রাজশাহী মেট্রোপলিটন এলাকায় বিভিন্ন পাড়া যেমন- বাগানপাড়া, পশ্চিম টালিপাড়া, শেখপাড়া, মোল্লাপাড়া, আলীগড়, মিয়াপুর, কলিমনগর, পবা নতুনপাড়া, বড় বন গ্রাম শেখপাড়া, রওদাপাড়া কুসর সেন্টার, কইকুরি, হলদিবোনা, সন্তোষপুর, গোপালপুর, আন্ধারকোঠাপাড়ায় বসবাসরত সাঁওতাল, পাহাড়িয়া ও ওঁরাওদের দুই হাজার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই দিনমজুর। তারা সবাই কভিড-১৯-এর লকডাউনে কর্মহীন হয়ে বাড়িতে অবস্থান করছে। যা সঞ্চয় ছিল তাও শেষ বা শেষের পথে। এসব পরিবার এখনও সরকারি ত্রাণ সহায়তা পায়নি।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার তিন গ্রামের প্রায় ১২০০ সাঁওতাল পরিবার করোনার লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। গ্রামগুলো হচ্ছে- কুয়ামারা, মাদারপুর ও জয়পুরপাড়া। জানা যায়, করোনা আতঙ্কে এ তিন গ্রামের অধিকাংশ মানুষ বাড়িতে কর্মহীন। তারা প্রশাসনের কাছ থেকে কোনো ধরনের সাহায্য পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নেতারা জানিয়েছেন, সিলেটের অধিকাংশ চা শ্রমিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর। তারা খাদ্য সংকট ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালিঘাট ইউনিয়নের ৩৫টি গারো পরিবারের দুই শতাধিক দরিদ্র মানুষ চরম দুর্ভোগে রয়েছেন। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, কক্সবাজারের চাকমা, তনচংগ্যা, রাখাইন এবং চাঁদপুরের ত্রিপুরা ও খুলনা-সাতক্ষীরার আদিবাসীরাও বর্তমান পরিস্থিতিতে খাদ্য সংকটের মধ্যে দিন অতিবাহিত করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের মধ্যে দিনমজুর, গরিব কৃষক ও প্রান্তিক জুমচাষিদের অবস্থা খুবই নাজুক। কভিড-১৯-এর পাশাপাশি হামের নতুন প্রাদুর্ভাব তিন পার্বত্য জেলাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।
আদিবাসী নেতারা আরও জানিয়েছেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত শত আদিবাসী পরিবার জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, ময়মনসিংহসহ বড় শহরগুলোতে বসবাস করে। যাদের বেশিরভাগ বিভিন্ন নিম্ন আয়ের পেশার সঙ্গে যুক্ত। শুধু ঢাকা শহরে শত শত আদিবাসী বিউটি পার্লার, বাসাবাড়ির দারোয়ান, ড্রাইভার ইত্যাদি পেশায় নিযুক্ত রয়েছে। করোনার বিরূপ পরিস্থিতিতে এদের অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। এই পরিবারগুলো এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে।
আদিবাসী সংগঠনগুলো দেশের প্রান্তিক ও দরিদ্র আদিবাসীদের ঘরে ঘরে সরকারি ত্রাণ সহায়তা দ্রুত পৌঁছানোর দাবি জানিয়েছে। পাশাপাশি তারা অন্যান্য দাতা ও উন্নয়ন সংস্থা এবং বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকেও মানবিক সহায়তা নিয়ে আদিবাসীদের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছে।
মন্তব্য করুন