করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় নিজেদের সুরক্ষিত রাখার চিন্তা থেকে বিশ্বের ৮০টি দেশ জরুরি স্বাস্থ্য সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন পণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা বা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। বিশেষত মাস্ক, ভেন্টিলেটর, পিপিই, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম রয়েছে এ তালিকায়। কোনো কোনো দেশ খাদ্য ও টয়লেট পেপারের মতো পণ্যের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার ফলে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়ে এই বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ শুরু হলেও বিশ্বমন্দার যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা মোকাবিলায় ধীরে ধীরে শিল্পপণ্যেও এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। বিশ্বায়ন থেকে সরে এসে বাণিজ্য উদারীকরণের পরিবর্তে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে যেতে পারে অনেক দেশ। এতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ডব্লিউটিওর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ৭৯টি দেশ করোনা প্রতিরোধে মুখ ও চোখের নিরাপত্তা পণ্যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এরপরেই রয়েছে নিরাপত্তামূলক পোশাক রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা। ৫০টি দেশ এ উদ্যোগ নিয়েছে। আর ৪৭টি দেশ গ্লাভস রপ্তানি বন্ধ রেখেছে। স্যানিটাইজার জাতীয় পণ্য রপ্তানি বন্ধ করেছে ২৮ দেশ। ওষুধ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ২০টি দেশ। আর খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে এই ব্যবস্থা আরোপ করেছে ১৭টি দেশ। ভেন্টিলেটরসহ অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ১০টি দেশ। করোনাভাইরাসের টেস্ট কিট রপ্তানি বন্ধ রেখেছে ছয়টি দেশ। তিনটি দেশ সাবান ও দুটি দেশ টয়লেট পেপার রপ্তানি বন্ধ রেখেছে।

ডব্লিউটিওর মাত্র ১৩টি সদস্য দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে সংস্থাটিকে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জানিয়েছে। এ দেশগুলো হলো- আলবেনিয়া, অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, কলম্বিয়া, কোস্টারিকা, মিসর, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জর্জিয়া, কোরিয়া, কিরগিজ, ম্যাসিডোনিয়া, থাইল্যান্ড ও ইউক্রেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশকে আলাদাভাবে ধরলে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ৩৯। এগুলোর মধ্যে কোন দেশ কোন পণ্য রপ্তানি বন্ধ রেখেছে বা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে, তা ডব্লিউটিওর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।

গত মার্চে দেশগুলো ডব্লিউটিওকে আনুষ্ঠানিকভাবে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি অবহিত করে। অন্যান্য সদস্য দেশ তা করেনি, যাকে ডব্লিউটিও বাণিজ্যে অসাধুতা হিসেবে দেখছে। এ ছাড়া কয়েকটি দেশ রয়েছে যারা ডব্লিউটিওর সদস্য নয়। সংস্থাটি বলছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের কোনো সমস্যা দেখা যায়নি। এতে বড় ধরনের সংকট দেখা দিতে পারে।

গত ১২ মার্চ বাংলাদেশ দেশে তৈরি মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার রপ্তানিতে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করে। অবশ্য গত ২ এপ্রিল এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর পরে আর কোনো নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কিনা জানা যায়নি। বর্তমানে বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জন্য নিরাপত্তামূলক পোশাক ও মাস্ক তৈরি হচ্ছে বলে পোশাক কারখানার মালিকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ও বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সাবেক সিনিয়র ইকোনোমিস্ট ড. মাশরুর রিয়াজ সমকালকে বলেন, করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন বিশ্বায়নের ধারায় কিছুটা পরিবর্তন আসবে। আঞ্চলিক জোটবদ্ধতা বা দেশভিত্তিক উদ্যোগ বাড়বে। এতে বাণিজ্যে রক্ষণশীলতা বাড়বে। এ জন্য স্বল্প মেয়াদে স্বাস্থ্য খাতে করোনাকেন্দ্রিক জরুরি পণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হবে। মধ্য মেয়াদে খাদ্য উৎপাদন কমে ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

মাসরুর রিয়াজ মনে করেন, করোনাভাইরাসের চিকিৎসা বিষয়ক পণ্যের সরবরাহের জন্য বাংলাদেশকে এখনই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চীন ও ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত। বর্তমানে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কতটা হতে পারে তা প্রক্ষেপণ করার কৌশল বের হয়েছে। সে অনুযায়ী চাহিদা বের করে সরকার দেশ দুটির কাছে ওইসব পণ্য চাইতে পারে।