লকডাউন নিয়ে সরকার তথা স্বাস্থ্য বিভাগের মধ্যে একটি দ্বিমুখী অবস্থান লক্ষ্য করছি। দেখে মনে হচ্ছে, একটি অংশ লকডাউন কার্যকরভাবে চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে। অপর একটি অংশ লকডাউন শিথিলের পক্ষে। মাঝখান থেকে কোনোটিই হচ্ছে না। প্রথম ২৬ মার্চ সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হলো। সেই ছুটিকে ঈদের ছুটি মনে করে হাজার হাজার মানুষ ঢাকা থেকে গ্রামে ফিরে গেলেন। একবার গার্মেন্টস খুলে দিয়ে শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনা হলো। আবার গার্মেন্টস বন্ধ ঘোষণা করে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হলো। তারা নিজ নিজ বাসা-বাড়িতে ফিরে গেলেন। এই আসা-যাওয়ার মধ্য দিয়ে সামাজিকভাবে একে অপরের সংস্পর্শে এলেন হাজার হাজার মানুষ। আবার কিছুদিন পর গার্মেন্টস খুলে দেওয়া হলো। পাশাপাশি ঈদ সামনে রেখে লকডাউন শিথিল করে মার্কেট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। যদিও বড় বড় মার্কেটের মালিকরা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ অবস্থায় ছোট ছোট দোকানপাট খুলে গেল। রাস্তায় মানুষের ভিড় বাড়ল। এরপরই কিন্তু প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। মনে রাখা প্রয়োজন, দেশে করোনা সংক্রমণের এখন পিকটাইম চলছে। এই সময়ে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। কোনো ভুল সিদ্ধান্ত জনগণের জন্য ভয়ংকর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারের প্রতি আহ্বান থাকবে, সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিন। এখানে আমার ব্যক্তিগত কিছু মতামত সবার সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। বর্তমানে দেশের ৬৪ জেলাতেই করোনার সংক্রমণ ঘটেছে। কিন্তু সব উপজেলায় এখনও সংক্রমণ ঘটেনি। আবার কিছু জেলায় সংক্রমণ ১০ জনের নিচে। কোনো জেলায় ১০০ জনের নিচে। আবার কোনো কোনো জেলায় ১০০ জনের বেশি। এই জেলাগুলোকে সবুজ, হলুদ ও লাল- এ রকম তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে পৃথক ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব জেলায় সংক্রমণ ১০ জনের কম সেগুলোকে সবুজ জোন। যেখানে সংক্রমণ ১০ জনের ওপরে এবং ১০০ জনের কম সেগুলোকে হলুদ জোন এবং ১০০ জনের ওপরে সংক্রমণ থাকা জেলাগুলোকে লাল জোনে ভাগ করা যায়। সবুজ জোনে সব কর্মকাণ্ড চলবে। সেখানে গার্মেন্টস, কারখানা ও দোকানপাট চালু থাকবে। শুধু সংক্রমিত ব্যক্তিদের আইসোলেশনে নিয়ে যেতে হবে। একইসঙ্গে তাদের কন্টাক্ট ট্রেসিং করে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে নিতে হবে। এভাবে এসব জেলায় সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যাবে। হলুদ জোনেও অর্থনৈতিক সব কর্মকাণ্ড চলবে। তবে বাইরে থেকে কোনো মানুষ ভেতরে এবং ভেতর থেকে কেউ বাইরে যেতে পারবে না। আক্রান্তদের আইসোলেশনে এবং তাদের কন্টাক্ট ট্রেসিং করে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে নিতে হবে। লাল জোনের অন্তর্ভুক্ত জেলাগুলোকে পুরোপুরি লকডাউন করতে হবে। যেসব এলাকায় সংক্রমণ বেশি প্রয়োজনে কারফিউ জারি করা যেতে পারে। এসব এলাকায় অধিক সংখ্যক মানুষকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। দেশে নমুনা পরীক্ষার পরিমাণ নূ্যনতম ১০ হাজারে উন্নীত করতে হবে। একইসঙ্গে কভিড ও নন-কভিড হাসপাতালকে পৃথক করতে হবে। করোনা পজিটিভ হওয়ার পর কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু হবে। এর আগ পর্যন্ত নন-কভিড হাসপাতালেই রোগী চিকিৎসা নেবেন। সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলো করোনা নেগেটিভ সনদ ছাড়া রোগী ভর্তি নিচ্ছে না। এতে অনেক রোগী প্রয়োজনীয় সেবা না পেয়েই মারা যাচ্ছেন। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। এ অবস্থায় প্রত্যেকটি হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিট থাকতে হবে। সন্দেহভাজন রোগী সেখানে স্বাভাবিক চিকিৎসা নেবেন। পরীক্ষায় পজিটিভ হলে তাকে কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে পাঠাতে হবে। এতে করে সব মানুষই চিকিৎসা পাবেন। একইসঙ্গে প্রত্যেকটি হাসপাতালে অক্সিজেন সাপোর্টের ব্যবস্থা থাকতে হবে। জেলা পর্যায়েও আইসিইউ সুবিধা ও ভেন্টিলেটর পৌঁছাতে হবে।

জীবন ও জীবিকার কথা বলে ঝুঁকিপূর্ণ এই সময়ে লকডাউন শিথিল কাম্য নয়। কারণ লকডাউন শিথিল বিপদ ডেকে আনবে। দুর্যোগকালে পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবণ করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।