নতুন করে এক হাজার ১৬২ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে আরও ১৯ জনের। আক্রান্ত ও মৃত্যু- দুটিতেই রেকর্ড হয়েছে গত চব্বিশ ঘণ্টায়। দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর এক দিনে এটিই আক্রান্ত ও মৃত্যুর সর্বোচ্চ সংখ্যা। কিছুতেই রোখা যাচ্ছে না প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের সংক্রমণ। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

গতকাল বুধবার সংক্রমণের ৬৬তম দিনে এসে আক্রান্তের সংখ্যা ১৭ হাজার ছাড়াল। মোট আক্রান্ত ১৭ হাজার ৮২২ জন। মৃত্যুর সংখ্যা আড়াইশ' পেরিয়ে ২৬৯ জনে পৌঁছাল। গত চব্বিশ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন আরও ২১৪ জন। এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৩৬১ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন।

গত সোমবার করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা প্রথমবারের মতো চব্বিশ ঘণ্টায় এক হাজার ছাড়ায়। পরদিন আক্রান্ত কিছুটা কমে এলেও গতকাল বুধবার এসে তা সর্বোচ্চ সংখ্যায় উপনীত হলো। এক দিনে মৃত্যুর সংখ্যা প্রথম ১০ জন হয় গত ১৬ এপ্রিল। ১৭ এপ্রিলে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৫ জন। পরপর আরও কয়েকদিন করোনায় ১০ জন করে মৃত্যু হয়। ৭ মে এক দিনে ১৩ জনের মৃত্যু হয়। এরপর ১২ মে মৃত্যুর সংখ্যা হয় ১১। তবে গতকাল আগের সব রেকর্ড ভেঙে ১৯ জনের মৃত্যু হলো।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণের পিকটাইম চলছে। কিন্তু এই সময়ে সবকিছু শিথিল করার চেষ্টা চলছে। একদিকে সরকারি ছুটি চলছে। অন্যদিকে গার্মেন্ট, ফ্যাক্টরি, দোকানপাট- সবকিছু চালু করা হচ্ছে। রাস্তায় যানজটও দেখা যাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ পরস্পরের সংস্পর্শে আসছেন। এভাবে ভাইরাসটি আরও ছড়িয়ে পড়বে। আরও মানুষ আক্রান্ত হবে। আরও মৃত্যু দেখতে হবে। এটি জানার পরও কেন এই ঝুঁকি সৃষ্টি করা হচ্ছে? যে জীবিকার কথা বলা হচ্ছে, জীবন না থাকলে জীবিকার সংস্থান করে কী লাভ হবে? এখনও সময় আছে লকডাউন জোরালোভাবে কার্যকর করতে হবে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জসহ যে কয়েকটি জেলায় সংক্রমণের মাত্রা বেশি, তাদের জন্য পৃথক পরিকল্পনা নিতে হবে। কার্যকর লকডাউন দিতে হবে এসব জেলায়। অন্যথায় সামনে আরও খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।

চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব সমকালকে বলেন, কার্যকর লকডাউন নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত প্রদানকারীরা দু'ভাগে বিভক্ত বলে মনে হয়। একদিকে দফায় দফায় সরকারি ছুটি বাড়ানো হচ্ছে। অন্যদিকে গার্মেন্ট, কারখানা, দোকানপাট খুলে দেওয়া হচ্ছে। এসব যদি খুলেই দেওয়া হয়, তাহলে সরকারি ছুটি বাড়ানোর কী প্রয়োজন? কাদের পরামর্শে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে জানি না। সর্বোচ্চ সংক্রমণের এই সময়ে এগুলো তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। সংক্রমণ ঠেকাতে কার্যকর লকডাউনের কোনো বিকল্প নেই। সরকারের প্রতি আহ্বান থাকবে, কার্যকর লকডাউন দিন। অন্যথায় প্রতিদিনই আক্রান্তও মৃত্যুর রেকর্ড দেখতে হবে।

আক্রান্ত ও মৃত্যুর টাইমলাইন

প্রথম সংক্রমণ : দেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা সংক্রমণ শুরু হয়। ওইদিন তিনজনের শরীরে সংক্রমণ শনাক্ত হয়।

প্রথম মৃত্যু : ১৮ মার্চ করোনা সংক্রমিত হয়ে প্রথম এক ব্যক্তির মৃত্যু হয় দেশে। একই দিন নতুন করে আরও চারজনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ১৪ জনে পৌঁছায়।

মৃত্যু বেড়ে ৬০, আক্রান্ত দেড় হাজার : ১৬ এপ্রিল ১০ জনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সংখ্যা পৌঁছায় ৬০ জনে। আক্রান্ত হয় আরও ৩৪১ জন। মোট আক্রান্ত এক হাজার ৫৭২ জন।

মৃত্যু বেড়ে ৭৫ : ১৭ এপ্রিল আরও ১৫ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মোট মৃত্যুর মৃত্যুর সংখ্যা হয় ৭৫। ওইদিন আরও ২৬৬ জন আক্রান্ত হয়। মোট আক্রান্ত এক হাজার ৮৩৮ জন।

মৃত্যু বেড়ে ১০১, আক্রান্ত ২ হাজার ৯৪৮ : ২০ এপ্রিল আরও ১০ জনের মৃত্যু হয়। মোট মৃত্যু ১০১ জন। ওইদিন নতুন করে ৪৯২ জন আক্রান্ত হয়। মোট আক্রান্ত ২ হাজার ৯৪৮ জন।

মৃত্যু বেড়ে ১২০, আক্রান্ত ৩ হাজার ৭৭২ : ২২ এপ্রিল মৃত্যু হয় ১০ জনের। নতুন করে আক্রান্ত হয় ৩৯০ জন। মোট আক্রান্ত ৩ হাজার ৭৭২ জন এবং মৃত্যু ১২০ জনের।

মৃত্যু বেড়ে ১৯৯, আক্রান্ত ১২ হাজার ছাড়ায় : ৭ মে আরও ১৩ জনের মৃত্যু হয়। আক্রান্ত হয় ৭০৬ জন। এ নিয়ে মোট আক্রান্ত ১২ হাজার ৪২৫ জনে ও মৃত্যু বেড়ে ১৯৯ জনে পৌঁছায়।

মৃত্যু বেড়ে ২২৮, আক্রান্ত ১৪ হাজার ছাড়ায় : ১০ মে ১৪ জনের মৃত্যু হয়। মৃতের সংখ্যা পৌঁছায় ২২৮ জনে। ওইদিন আক্রান্ত হয় আরও ৮৮৭ জন। মোট আক্রান্ত ১৪ হাজার ৬৫৭ জনে পৌঁছায়।

আক্রান্ত ১৫ হাজার ছাড়ায় : ১১ মে ১০ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মৃতের সংখ্যা ২৩৯ জনে পৌঁছায়। ওইদিন আক্রান্ত হয় এক হাজার ৩৪ জন। মোট আক্রান্ত ১৫ হাজার ৬৯১ জনে পৌঁছায়।

মৃত্যু বেড়ে ২৫০, আক্রান্ত ১৬ হাজার ছাড়ায় : ১২ মে ১১ জনের মৃত্যু হয়। এতে করে মোট মৃত্যু ২৫০ জনে পৌঁছায়। আক্রান্ত হয় ৯৬৯ জন। মোট আক্রান্ত ১৬ হাজার ৬৬০ জনে পৌঁছায়।

মৃত্যু বেড়ে ২৬৯, আক্রান্ত ১৭ হাজার ছাড়াল : গতকাল ১৩ মে ১৯ জনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে মোট মৃত্যু হলো ২৬৯ জনের। নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে এক হাজার ১৬২ জন। মোট আক্রান্ত ১৭ হাজার ৮২২ জনে পৌঁছাল।

করোনা পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত বুলেটিনে গতকাল বুধবার মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা মৃত্যু ও আক্রান্তের তথ্য তুলে ধরেন। মৃতদের বিস্তারিত তুলে ধরে তিনি বলেন, মারা যাওয়া ১৯ জনের মধ্যে ১২ জন পুরুষ, সাতজন নারী। এর মধ্যে ঢাকা শহরে ১৩ জন, নারায়ণগঞ্জে একজন, মুন্সীগঞ্জে একজন, খুলনা বিভাগে একজন এবং চট্টগ্রাম বিভাগে তিনজন। বয়স বিশ্নেষণে দেখা যায়, ০ থেকে ১০ বছরের মধ্যে একটি মেয়েশিশু রয়েছে মৃত্যুর তালিকায়। এ ছাড়া রয়েছে ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে একজন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে সাতজন, ৬১ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে পাঁচজন, ৭১ থেকে ৮০ বছরের মধ্যে পাঁচ জন।

নমুনা পরীক্ষায় ল্যাবের সংখ্যা বৃদ্ধির তথ্য তুলে ধরে ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার জন্য রাজধানীতে আরও দুটি এবং ঢাকার বাইরে আরও একটি নতুন ল্যাবরেটরি যুক্ত হয়েছে। নতুন ল্যাব তিনটি হলো- ঢাকার বেসরকারি ইবনে সিনা হাসপাতাল ও প্রাভা হেলথ এবং ঢাকার বাইরে জামালপুরের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ। এ নিয়ে ল্যাবের সংখ্যা ৪১টিতে পৌঁছেছে। এগুলোতে গত চব্বিশ ঘণ্টায় সাত হাজার ৮৬২টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। আগের কিছু মিলিয়ে পরীক্ষা করা হয় সাত হাজার ৯০০টি। এ নিয়ে দেশে মোট নমুনা পরীক্ষা করা হলো এক লাখ ৪৪ হাজার ৫৩৮টি।

আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইনের তথ্য তুলে ধরে ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, চব্বিশ ঘণ্টায় আইসোলেশনে নেওয়া হয়েছে আরও ১৫০ জনকে। বর্তমানে আইসোলেশনে রয়েছে তিন হাজার ৪৩৫ জন। চব্বিশ ঘণ্টায় আইসোলেশন থেকে ছাড়া পেয়েছে ৭৬ জন। এ পর্যন্ত ছাড়া পেয়েছে এক হাজার ৩৩২ জন। একই সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টায় হোম ও প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে নেওয়া হয়েছে দুই হাজার ৫৫৮ জনকে। এ পর্যন্ত কোয়ারেন্টাইনে নেওয়া হয়েছে মোট দুই লাখ ২৭ হাজার ৬৪২ জনকে। গত চব্বিশ ঘণ্টায় কোয়ারেন্টাইন থেকে ছাড়া পেয়েছে দুই হাজার ৬৬২ জন। মোট ছাড়া পেয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ৩৬১ জন। বর্তমানে হোম ও প্রাতিষ্ঠানিক মিলিয়ে কোয়ারেন্টাইনে রয়েছে ৪৫ হাজার ২২১ জন।

আক্রান্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থাপনার বিষয়টি তুলে ধরে দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাপরিচালক বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কোয়ারেন্টাইনের জন্য ৬১৭টি প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে সেবা দেওয়া যাবে ৩১ হাজার ১৬৫ জনকে। সারাদেশে আইসোলেশন শয্যা আছে আট হাজার ৬৩৪টি। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে দুই হাজার ৯০০টি ও ঢাকার বাইরের হাসপাতালে পাঁচ হাজার ৭৩৪টি। এ ছাড়া আইসিইউ শয্যা আছে ৩৩৫টি এবং ডায়ালাইসিস ইউনিট আছে ১০২টি।