চিরবিদায় নিলেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন তিনি।

সমকালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণযুগ ছিল ষাটের দশক। ২০১৯ সালের ০১ জুলাই সমকালের প্রিন্ট সংস্করণে সম্পাদকীয় ও মন্তব্য পাতায় প্রকাশিত তার ওই সাক্ষাৎকারটা নিয়েছিলেন শেখ রোকন। সমকাল অনলাইনের পাঠকদের জন্য সেটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো-

১৯২১ সালের ০১ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আর এক বছর পর এই ভূখণ্ডের প্রথম ও প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়টি শতবর্ষ পূরণ করতে যাচ্ছে। এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে সমকালের বিশেষ আয়োজনে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের নায়ক ও আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ, ডাকসুর প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী ভিপি মাহফুজা খানম। সাক্ষাৎকার তিনটি গ্রহণ করেছেন শেখ রোকন

সমকাল: জীবনের ৬৫ বছর ধরে নানাভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আপনি জড়িত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম প্রথম কখন শুনেছিলেন?

আনিসুজ্জামান: এখন ঠিকঠিক মনে নেই। সম্ভবত সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়। নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় লক্ষ্য ঠিক করেছিলাম, এই বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ব। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়ব।

সমকাল: আপনি ভর্তি হলেন ১৯৫৩ সালে। তারও আগে ভাষা আন্দোলনে যোগ দিতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসেছেন। কেমন ছিল পড়াশোনার পরিবেশ?

আনিসুজ্জামান: যথেষ্ট ভালো ছিল। সবাই সবাইকে চিনত। ক্যাম্পাস অনেক ছোট ছিল। ছাত্রছাত্রী তিন হাজারের বেশি না। আইন বিভাগে অবশ্য বেশি ছিল। বয়স্করাও পড়তে আসতেন। বাংলা বিভাগে আমাদের ব্যাচে ভর্তি হলাম ১০ জন। এর মধ্যে দু'জন ছাত্রী। আগের ব্যাচে ছাত্রছাত্রী ছিল আরও কম, মাত্র দু'জন।

সমকাল: এত কম ছাত্রছাত্রীর কারণ কী?

আনিসুজ্জামান: তখন বেশিরভাগ বিভিন্ন কলেজে বিএ পাসকোর্সে পড়াশোনা করত। অনার্স পড়ার কষ্ট করতে চাইত না।

সমকাল: পড়াশোনার খরচ কি একটি বিবেচ্য বিষয় ছিল?

আনিসুজ্জামান: কারও কারও জন্য ছিল। কিন্তু সেটা ছিল সামান্য, জোগাড় করা কঠিন ছিল না। এখনকার মতো ভর্তিযুদ্ধের ব্যাপারও ছিল না। আইএ পাস করে যে কেউ ভর্তি হতে পারত।

সমকাল: আপনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন শেষবারের মতো একজন ইংরেজ উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ওয়াল্টার অ্যালেন জেনকিনস।

আনিসুজ্জামান: তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতেই পদার্থবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তার আগে ঢাকা কলেজে পদার্থবিদ্যার শিক্ষক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি অবসর গ্রহণ করেন।

সমকাল: আপনাদের সময়ে শিক্ষক নিয়োগ হতো কীভাবে? তখনও কি বিদেশি শিক্ষক নিয়োগ হতো?

আনিসুজ্জামান: পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত দেশি-বিদেশি শিক্ষক নিয়োগ হতো; রীতিমতো বিজ্ঞপ্তি দিয়ে। পদার্থবিদ্যা, আইন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে বেশ কিছু বিদেশি শিক্ষক ছিলেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হতো; অ্যাডহক ভিত্তিতে। ছয় মাস তার পারফরম্যান্স বিবেচনা করে স্থায়ী করা হতো।

সমকাল: তখন উপাচার্য নিয়োগ হতো কীভাবে?

আনিসুজ্জামান: যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার পাশাপাশি শিক্ষার প্রতি তার অনুরাগ বিবেচনা করা হতো। সরকারই নিয়োগ দিতো; কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনা স্থান পেত না। তবে সামরিক শাসনামলে, বিশেষ করে আইয়ুব খানের সময় উপাচার্য নিয়োগে রাজনীতিকীকরণ শুরু হয়। যারা সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল, তাদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়।

সমকাল: শিক্ষক বা উপাচার্য নিয়োগে ক্যাম্পাসের ভেতরের শিক্ষক রাজনীতি বা ছাত্র রাজনীতির কোনো ভূমিকা ছিল?

আনিসুজ্জামান: তখন ছাত্র সংগঠনের নাম ধরে বিশ্ববিদ্যালয় বা হল ছাত্র সংসদেরও নির্বাচন হতো না। শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের তো প্রশ্নই ওঠে না। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা থাকলে নির্বাচনে অংশ নিত অরাজনৈতিক নাম দিয়ে। যেমন একটি দলের নাম ছিল অভিযাত্রিক। আমি যে বছর ভর্তি হলাম, তার পর থেকে শুরু হলো ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন নামে নির্বাচন। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে তখন সক্রিয় ছিল নিখিল পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, ইসলামিক ব্রাদারহুড।

সমকাল: ইসলামিক ব্রাদারহুড মানে মিসরের সেই আন্দোলন?

আনিসুজ্জামান: হ্যাঁ, তখন তাদের প্রকাশ্য শাখা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সমকাল: আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, শিক্ষকতাও করেছেন। তখনকার ও এখনকার ছাত্রদের মান যদি তুলনা করতে বলি।

আনিসুজ্জামান: এখনকার যারা ভালো, তারা আমাদের সময়কার ভালোর চেয়েও ভালো। কিন্তু গড় মান কমে গেছে। তখন বাংলা ও ইংরেজিতে সবাই সাবলীলভাবে ভাব প্রকাশ করতে পারত, লিখতে পারত। এখন বেশিরভাগই ভালোভাবে বাংলা জানে না। ভালোভাবে ইংরেজিও জানে না। তখন বইপত্র পড়ার প্রতি ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ ছিল; এখন পূর্ববর্তী ছাত্রদের নোট পড়ে পরীক্ষা দেয়।

সমকাল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার গড় মান কখন থেকে কমা শুরু হয়েছে?

আনিসুজ্জামান: আমার পর্যবেক্ষণে সত্তর দশক থেকে। বাংলাদেশ আমলে এসে।

সমকাল: এর কারণ কী?

আনিসুজ্জামান: এর কারণ ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি। ছাত্রছাত্রী বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষকদের পক্ষে সবার প্রতি সমান মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না। আর ভর্তি পরীক্ষা ব্যবস্থা। আগে ছাত্রছাত্রীরা যে বিষয়ে পড়তে চাইত, সে বিষয়ে পড়তে পারত। ভর্তি পরীক্ষা ব্যবস্থার কারণে যে বিষয়ে আগ্রহ নেই, সে বিষয়ে ভর্তি হতে হয়। শতকরা ১০ ভাগও আগ্রহের বিষয়ে ভর্তি হতে পারে না। ফলে পড়াশোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ছাত্র রাজনীতির মান পড়ে যাওয়াও একটি কারণ। এতে করে স্বাভাবিক পড়াশোনার পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে।

সমকাল: স্বাধীনতার আগে ও পরে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের মানের ব্যাপারে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

আনিসুজ্জামান: আগের তুলনায় শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা, পদোন্নতির সুযোগ বেড়েছে। এগুলো শিক্ষকতায় আগ্রহ ও মনোযোগ বাড়াতে কাজে লাগার কথা ছিল। কিন্তু এখন তারা পড়ানোর চেয়ে এগুলোর জন্যই বেশি ব্যগ্র থাকেন। শিক্ষকদের মধ্যে এখন যেমন দলাদলি, এটা তখন ছিল না। যদিও সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে শিক্ষকদের অবস্থান ছিল; কিন্তু সেটা প্রকাশ্য দলাদলি ছিল না।

সমকাল: কেমন এমন হলো?

আনিসুজ্জামান: এটা একদিনে হয়নি। বহুদিন ধরে ক্রমে ক্রমে এমন ব্যক্তিরা শিক্ষকতায় এসেছেন, যারা শিক্ষকতা না করে অন্য কিছু করলে ভালো করতেন। আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের কাছে আইকন শিক্ষকের সংখ্যা অনেক ছিল। এখন ছাত্রদের কাছে আইকন কমে গেছে।

সমকাল: এ থেকে উত্তরণের পথ কী?

আনিসুজ্জামান: সবাই মিলে, ছাত্র-শিক্ষক-সরকার মিলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো থাকতে দিতে হবে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করা যাবে না। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি করা যাবে না। শিক্ষকদের রাজনৈতিক সমর্থন থাকতে পারে। কিন্তু সেটা যেন তার মূল যে দায়িত্ব পাঠদান, সেখানে যেন প্রভাব না ফেলে, এটা নিশ্চিত করতে হবে। এটাও নিশ্চিত করতে হবে, যে কোনো রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার আবহ বিঘ্নিত হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। এখন যেমন হল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন নিয়ে নিয়েছে। শিক্ষকদের আবাসনের বিষয় রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে বের হতেই হবে।

সমকাল: শিক্ষা ও গবেষণার বৈশ্বিক সূচকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমে পিছিয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ বলছেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গৌরব জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা। আপনি কী বলেন?

আনিসুজ্জামান: আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ পঠন-পাঠন, গবেষণা। সেদিকে অগ্রসর হতে না পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্যই বিচ্যুত হয়। জাতীয় ক্ষেত্রে আমরা যতই ভূমিকা রাখি না কেন, শিক্ষা ও গবেষণায় উন্নতি করতে না পারলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়কে উন্নত বলা যায় না।

সমকাল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতিতে আপনি কি হতাশ?

আনিসুজ্জামান: ঠিক হতাশ নই, কিন্তু আশাবাদী হতে পারছি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণযুগ ছিল ষাটের দশক। অনেকে এটাকে রাজনৈতিকভাবে সোনালি যুগ মনে করেন। আমি মনে করি, শিক্ষা ও গবেষণার জন্যও সোনালি যুগ ছিল। আমি দেশ বিভাগের আগের কথা বলছি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময় আর চাইলেও ফিরিয়ে আনা যাবে না। কিন্তু আমি একাডেমিকভাবেও ষাটের দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফেরত চাই। তখনও আমাদের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের গবেষণার খবর বিশ্ব জানত। তখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বব্যাপী সমীহ করা হতো।