- বাংলাদেশ
- বন্ধুবৎসল আনিসুজ্জামান
বন্ধুবৎসল আনিসুজ্জামান

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান (জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭-মৃত্যু: ১৪ মে ২০২০)- ছবি সাজ্জাদ নয়ন
চলে গেলেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
এ বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জন্মদিন উপলক্ষে খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক লিখেছিলেন, 'বন্ধুবৎসল আনিসুজ্জামান'। সমকালের প্রিন্ট সংস্করণে প্রকাশিত লেখাটি সমকাল অনলাইনের পাঠকদের জন্য পুনঃপ্রকাশ করা হলো-
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে কোন অভিধায় অভিহিত করব! আমাদের প্রিয়জন অগ্রজ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ৮০ বছর অতিক্রম করেছেন আরও আগেই। আজ তিনি আরও একটি বছর অতিক্রম করতে চলেছেন। প্রথমেই তাকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। এখনও তিনি আমাদের মাঝে সচল আছেন, সবখানে উপস্থিত হয়ে অনুপ্রাণিত করছেন- এ তো নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য খুব সুখকর বিষয়। তিনি আরও দীর্ঘদিন আমাদের মাঝে এভাবেই সচল-কর্মময় থাকুন, এ শুভকামনা রইল তার জন্মদিনে।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। স্কুলজীবনের কিছুটা কেটেছেও সেখানে। সম্ভবত অষ্টম শ্রেণি থেকে ঢাকায় তার নতুন করে শুরু হয় পড়াশোনা। শিক্ষাজীবন শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে শুরু হয় জীবনের নতুন করে আরেক ধাপ পথচলা। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেছেন। বরেণ্য শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, অনুবাদক, ভাষাসংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা- এমন কত পরিচয়েই তো তিনি পরিচিত। দেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের অন্যতম অগ্রবর্তীজন আনিসুজ্জামানের অর্জনের ঝুলি পূর্ণ। দেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক দায়িত্বভার তার ওপর বর্তেছে এবং সব ক্ষেত্রেই তিনি নিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে কর্মযজ্ঞ চালিয়েছেন, সম্পন্ন করেছেন দায়িত্ব। যদি বলি এখনও তিনি সৃষ্টিশীলতা-সৃজনশীলতার পথে অবিচল, তাহলে মোটেও বাড়িয়ে বলা হবে না।
বাংলাদেশে দৃষ্টান্তযোগ্য, অনুসরণযোগ্য মানুষের সংখ্যা ক্রমে কমছে। কিন্তু আমাদের মাঝে আনিসুজ্জামান এখনও সচল আছেন অনুসরণযোগ্য হিসেবে। বরাবর নীতিনিষ্ঠ অগ্রজ এই কর্মবীরকে নিয়ে ছোট্ট পরিসরে লিখে শেষ করার নয়। বন্ধুবৎসল আনিসুজ্জামানকে নিয়ে এর আগেও আমি লিখেছি। কিন্তু আমি আজ কৃতজ্ঞচিত্তে এ কথাটা উল্লেখ করতে চাই, তাকে নিয়ে আমি যা লিখেছি আমাকে নিয়ে তিনি লিখেছেন এর চেয়ে অনেক বেশি। তিনি কতটা বন্ধুবৎসল এর প্রমাণ আমার প্রতি তার ভালোবাসা ও মমত্ববোধ থেকে গভীরভাবে অনুধাবন করেছি। তার সৃষ্টির ভাণ্ডার যেমন সমৃদ্ধ, তেমনি তার কাজের সীমানাও অনেক বিস্তৃত। বহু বিষয়ে জ্ঞান অর্জনকারী এই ব্যক্তিত্ব আমাদের গর্ব-অহঙ্কার। তাকে ঘিরে আমাদের প্রত্যাশাও এ জন্যই আজও অফুরন্ত।
সাহিত্য নিয়ে তার অনেক কাজই সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তার প্রকাশিত গ্রন্থ তালিকা দিতে গেলে এই লেখার কলেবর বেড়ে যাবে। মৌলিক গ্রন্থ, অনুবাদ, সম্পাদনা গ্রন্থ- সব মিলিয়ে তার কাজের পরিসর অনেক বড়। অর্থাৎ এ পরিপ্রেক্ষিতে এটুকু বলা যায়, তার সৃষ্টি বা কর্মযজ্ঞ আমাদের এক সমৃদ্ধ ভাণ্ডার। পুরস্কার-সম্মাননা তো কতই অর্জন করেছেন। একজন গুণী মানুষের পূর্ণাঙ্গতা নিয়ে আনিসুজ্জামান এখনও যে আলো ছড়াচ্ছেন, তা আমাদের অনুপ্রাণিত করে। তিনি ছাত্রদের কাছে প্রিয় ছিলেন তার সফল শিক্ষকতার জন্য। আজও তিনি সেরকমভাবেই প্রিয় হয়ে আছেন শিক্ষকতায় সম্পৃক্ত না থাকলেও। তার অনেক গ্রন্থই আমাদের কাছে অনন্য দলিল। তার আদর্শ ও জীবনকর্ম আমাদের গর্বিত করে।
আরও একটি কথা বলা খুব আবশ্যক মনে করি। আমাদের সমাজ ও সমকাল উভয়ের জন্যই আনিসুজ্জামানকে বড় বেশি প্রয়োজন। একজন পূর্ণাঙ্গ আধুনিক মানুষ হিসেবে আধুনিকতার প্রতিটি বিষয় তার চরিত্রের ভেতর গভীরভাবে বিরাজিত, এটা আমার বিশ্বাস। মুক্তচিন্তক, বহুত্ববাদী সংস্কৃতজন, ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক-বাহক, প্রগতিশীল চিন্তাস্নাত এই জ্ঞানীকে আমরা যত উচ্চাসনে রাখব, আমরা নিজেরাই ততই গর্বিত হবো। তিনি তার কর্মে ও সৃজনে অনন্যতায় ব্যাপৃত। আমরা এ জন্যও গর্ববোধ করি যে, দেশ-বিদেশের বিদ্বজ্জন তার পাণ্ডিত্য ও মানবিক বোধকে শ্রদ্ধার সঙ্গে মূল্যায়ন করছেন। এই যে বিশিষ্টতায় তিনি নন্দিত ও বরণীয়, তাও তো আমাদের গর্বের অধ্যায়কে করেছে আরও বিস্তৃত। তার কর্ম পরিমাপহীন। তার চিন্তা নৈর্ব্যক্তিক, সর্বোপরি তিনি একজন সার্থক জীবনাধিকারী।
সময়ের এক অগ্রগণ্য মানুষ আনিসুজ্জামানের হাতে অনেক ক্ষেত্রে প্রাণ পেয়েছে শিল্প-সংস্কৃতির আন্দোলন। জ্ঞানের চর্চায় আলোকিত করেছেন শিক্ষাঙ্গন। তার জন্মদিনে কামনা করি তিনি আমাদের মাঝে প্রাণবন্ত থাকুন দীর্ঘদিন। তিনি আমাদের সম্পদ।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক
মন্তব্য করুন