বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান চলে গেলেন না ফেরার দেশে। বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। ২০১৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের দাম্পত্য জীবন নিয়ে লিখেছেন সমকালের সহকারী সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম আবেদ। সমকালের প্রিন্ট সংস্করণে প্রকাশিত লেখাটি সমকাল অনলাইনের পাঠকদের জন্য পুনঃপ্রকাশ করা হলো-

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান- আমাদের শিক্ষক। এর বাইরে তার আরও অনেক পরিচয়- লেখক, গবেষক, সম্পাদক, সমাজের দিকনির্দেশক। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার পদচারণা এবং অবস্থান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাতিঘর সমতুল্য। তার বহুমাতৃক কর্মকাণ্ড এবং অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক, দাউদ পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, আনন্দ পুরস্কার, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিলিটসহ পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার, পদক আর সম্মান। সম্প্রতি ভারত সরকার তাকে ভূষিত করেছে পদ্মভূষণ পদকে। জীবনের এত অর্জনকে ছাপিয়েও আনিসুজ্জামান স্যারের শিক্ষক পরিচয় আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় ও প্রিয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রিয় শিক্ষক পা রাখছেন ৭৮ বছর বয়সে। এর মধ্যে অতিক্রম করেছেন সংসার জীবনের ৫২ বছর। কেমন সেই জীবন- যেখানে তার পরিচয় ভাই, স্বামী, বাবা কিংবা দাদু? কতটা গভীর সেই ভালোবাসার বন্ধন।

তাদের স্নেহ, ভালোবাসা পারিবারিক জীবনের বন্ধনের কথা জানতে সাতসকালে হাজির হই স্যারের বাসায়। ইচ্ছে ছিল স্যার এবং তার স্ত্রী সিদ্দিকা জামানকে একসঙ্গে করেই শুরু করব আলাপচারিতা। কিন্তু বিধিবাম। সিদ্দিকা জামান একটা কাজে বাইরে গেছেন। স্যার বললেন একটু পরেই ফিরে আসবেন। কিন্তু কথা তো আর থেমে থাকার নয়। শুরুটা হলো 'বিজয়লক্ষ্মী নারী' নিয়ে। জানতে চাই স্যারের জীবনে এটা কতটা সত্য। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়েই যেন ডুব দিলেন ভাবনায়। হারিয়ে গেলেন দূর কোনো দেশে। একটু পর শুরু করলেন, 'আমার জীবনের প্রথম পর্যায়ে মায়ের শিক্ষা বা প্রভাব কার্যকর হয়েছে। মায়ের নির্দেশিত পথে চলেছি। আমার জীবনাচরণ তৈরি হয়েছে মায়ের কাছ থেকে। এর পর মেজ বোন তৈয়ামুন নেসা- আমার পড়াশোনার দেখভাল থেকে শুরু করে নানা বিষয় তার তত্ত্বাবধানেই হয়েছে। বড় বোন তৈয়বুন নেসা, তার ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আর ছোট বোন ছিল বন্ধুর মতো। বিয়ের পর সব কাজের সঙ্গী হিসেবে পেয়েছি আমার স্ত্রীকে। পরিবারের সব দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজ কাঁধে তুলে নিয়ে আমাকে আমার কাজ করে যেতে দিয়েছে। কোনো কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। কাজেই, আজকের এই যে আমি, এর পেছনে অবশ্যই নারীর অবদান রয়েছে। রয়েছে তাদের স্নেহ, ভালোবাসা।

তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ বন্ধুর মামাতো বোন। পরিচয় হওয়ার পর যত না দেখাদেখি, তার চেয়ে বেশি হতো টেলিফোনে কথা। সেখান থেকেই ভাবের আদান-প্রদান, প্রেম-পরিণয় সিদ্দিকা জামানের সঙ্গে। তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক। একই সঙ্গে চলছে পিএইচডি গবেষণা। আর সিদ্দিকা জামান ইডেন কলেজের বিএ ক্লাসের ছাত্রী। 'চিন্তা-ভাবনা, মনোভঙ্গির মিল ছিল বলেই বোধ করি আমরা পরস্পরে যুক্ত হতে পেরেছিলাম।' কতটা মিল, শতভাগ? প্রশ্ন শুনে স্যার একটু হেসে বলেন, 'একটা মানুষের সঙ্গে আরেকটা মানুষের ভাবনা, রুচি, কখনোই শতভাগ হতে পারে না। সেখানে পারস্পরিক সহনশীলতা, আস্থা-সম্মান দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। দাম্পত্য জীবনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, '৫২ বছরের এই যে বন্ধন, পথচলা_ সেখানে বোঝাবুঝির গোলমাল হয়েছে, দ্বন্দ্ব হয়েছে; সেটা মিটিয়েও নেওয়া গেছে। বর্তমান প্রজন্ম, সম্ভবত আমাদের প্রজন্মের চেয়ে কিছু কম সহনশীল। সহনশীলতার অভাব নানা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করছে।' একটু ফুরসত না দিয়েই বলে ওঠেন, 'এখন অনেক বেশি ভোগ্যপণ্যের ছড়াছড়ি। ফলে মানুষের চাহিদাও বাড়ছে। জীবনে দ্রুত সব কিছু পেতে চায়। আমাদের তারুণ্যে এই বিষয়গুলো ছিল না।' জানালেন, নিজের ভাবনায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে কেটেছে ১৬ বছরের বেশি সময়। আবার স্ত্রীর ইচ্ছায় ফিরে এসেছেন ঢাকায়।

আমরা দু'জনা স্বর্গ খেল না কথার মধ্যেই বেজে ওঠে কলিংবেল। নাতি সাম্যকে সঙ্গে নিয়ে ফিরলেন সিদ্দিকা জামান। ঘরে ঢুকে মিষ্টি হাসলেন, যে হাসিতে একই সঙ্গে খেলে গেল অতিথিকে সম্ভাষণ, মায়ের স্নেহ, বোনের আদর। প্রসঙ্গে অংশগ্রহণে একটুও সময় নিলেন না। স্যার তখন কথা বলছিলেন পরিবারের জন্য স্ত্রীর ত্যাগের কথা, চাকরি ছেড়ে দেওয়া, ছেলেমেয়ের পড়াশোনার দায়িত্ব নেওয়া। কিন্তু এত কিছুর পরও কোনো অভিযোগ না করা। ছোট্ট শ্বাস টেনে বলেন, 'এখন মনে হয় ছেলেমেয়েকে, পরিবারকে আর একটু সময় দিলেই পারতাম।' স্যারের সব কথাকে উড়িয়ে দিয়ে সিদ্দিকা জামান বলেন, 'আমার এই নিয়ে কোনো আফসোস নেই। আমি যা কিছু করেছি খুব আনন্দের সঙ্গেই করেছি।' ১৯৬০ সালের শেষের দিকে পরিচয়পর্বের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, 'আমি কিন্তু একজন লেখককেই ভালোবেসে ছিলাম। তাই লেখার টেবিলে ওকে দেখতেই বেশি আনন্দ পাই। যখন লেখালেখি করে, কোনো সেমিনারে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়, ওটাই আমার আনন্দের সময়। সব সময় চেয়েছি ও ভালো থাকুক। পারস্পরিক সমঝোতা, সহযোগিতা, সম্মান এ নিয়েই আমার ভালোবাসার সংসার।' ভুল বোঝাবুঝির কথা বলতেই, থামিয়ে দিয়ে বলেন, 'তোমাদের স্যার বলেন, আমার ভুলো মন।' আর আমি বলি, 'আমার ভুলো মন বলেই এ সংসার করে যেতে পারলাম। ভুল বোঝাবুঝির সময় পেলাম কোথায়। কোনো বিষয় নিয়ে একটু মন খারাপ হয়েছে, আপনাদের মতো কেউ এসে হাজির। আমার না হেসে উপায় আছে? আর সেই হাসির সঙ্গেই ভুলে যাই পেছনের কথা।' রবীন্দ্রনাথ বলেছেন না-

'তুমি যে তুমি, ওগো/সেই তব ঋণ/আমি মোর প্রেম দিয়ে শুধি চিরদিন।'

'আমিও তাই করে যাই।'

... সংসার যে স্বামী ও স্ত্রীর পরস্পরের প্রেম-প্রীতি-স্নেহ ও শ্রদ্ধার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে_ আনিসুজ্জামান ও সিদ্দিকা জামানের সুদীর্ঘ ৫২ বছরের সফল দাম্পত্য তার বড় এক উদাহরণ। আমাদের সমাজ ও জীবনে এ রকম পারিবারিক বিবেচনাবোধ সবার জন্য বড় এক প্রেরণা।