আনিসুজ্জামান স্যারের মৃত্যু আমাদের জন্য কতটা শোকাবহ, এটা পরিমাপ করা খুবই কঠিন। যে তুমুল শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে আজ বাঙালি জাতির জীবনে, সেই শূন্যতা পূরণ করা সম্ভব নয় বলেই মনে করি। তার এই শূন্যতা পূরণ এভাবেই সম্ভব যে, শারীরিক মৃত্যুকে মেনে নিয়ে তার জ্ঞান এবং দর্শনের জায়গাটিকে ধরে জাতি এবং পরবর্তী প্রজন্ম যদি এগিয়ে যায়, তবেই মনে হবে তিনি কোনো শূন্যতা রেখে যাননি।
তিনি ছিলেন আধুনিকতম মানুষ। সমাজের প্রতিটি বিষয় নিয়েই তিনি গভীর চিন্তা করতেন। এবং সেই গভীরতা বোধ দিয়ে আলোকিত করতেন তার চারপাশের মানুষকে। ষাটের দশকে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, তখন পাকিস্তান সরকার রেডিও, টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ করে। তখন দেখেছিলাম সেই তুমুল সময়ে এই চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করে ১৯৬৮ সালে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি চারশ' পৃষ্ঠার একটি সংকলন সম্পাদনা করেন। ভাবতে অবাক লাগে, সেই চ্যালেঞ্জকে তিনি জ্ঞানের জায়গা থেকে মোকাবিলা করেছিলেন এবং প্রয়োজনে তিনি রাজপথেও নেমেছিলেন।
এই আধুনিক মানুষটির চিন্তা এবং আধুনিকতার প্রতিটি বিষয় তার চরিত্রের মধ্যে গভীরভাবে বিরাজিত ছিল। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের মানুষ, মুক্তচিন্তার মানুষ, সংস্কৃতির বহুত্ববাদে বিশ্বাসী, নিজের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল, প্রগতির চিন্তায় স্নাত; এমন আধুনিকতম মানুষ সমাজমণ্ডলে খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। যে কেউ তার কাছ থেকে আধুনিকতার পাঠ গ্রহণ করতে পারে। এ জন্য শ্রেণিকক্ষের দরকার হয় না। তার অমিয় সৃষ্টি, তার শারীরিক ভাষা, তার চলন-বলন এবং আচরণের দিকে চোখ খুলে রাখলেই অনেক কিছু শেখা যায়।
আনিসুজ্জামান স্যারকে সামনাসামনি আমি অনেকবার বলেছি, স্যার আমি আপনার ক্লাসের ছাত্রী হতে পারিনি, কিন্তু আপনি আমাকে যে শিক্ষা দিয়েছেন সেটা আমার জীবনের শিক্ষা। নিজেকে চেনার শিক্ষা এবং কঠিন সময়েও ঘুরে দাঁড়ানোর শিক্ষা। ব্যক্তিগতভাবে আমার চিন্তার মধ্যে যে অপরিসীম জায়গা তিনি তৈরি করে দিয়েছেন, তা আমার জীবনে আনিসুজ্জামান স্যারের বিরাট একটি কাজ বলেই মনে করি। তাঁকে আমি আমার একজন শিক্ষক হিসেবেই গণ্য করব সারা জীবন।
২০১১ সালের ২৮ ডিসেম্বর আনিসুজ্জামান স্যারের মেয়ের জামাতা সুমন হায়দার চৌধুরীর মৃত্যুদিনের কথা খুব মনে পড়ছে। সুমন হায়দার চৌধুরীর বাবা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। সুমন হায়দারের মৃত্যুর দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনিসুজ্জামান স্যারের বাসায় গিয়ে শোকসন্তপ্ত পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সেদিন আমরা অনেকে স্যারের বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার যখন শিক্ষকতা করতেন, সেই সময়কার একজন প্রহরী স্যারকে ফোন দিয়ে শোক জানান। স্যার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে আসেন ১৯৮৫ সালে, আর ২০১১ সালে এই অকাল মৃত্যুর ঘটনায় সে সময়কার একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রহরী তাকে স্মরণ করে সান্ত্বনা দেন, আমার মনে হয়, ওই ফোনটি তাকে দারুণ শক্তি জুগিয়েছিল। কারণ সরকারপ্রধান থেকে একজন সাধারণ মানুষ, এর মাঝে ব্যবধান অনেক, যা আসলে ভাবাই যায় না। এ ঘটনায় বুঝতে পারি, সব শ্রেণির মানুষের কাছে আনিসুজ্জামান স্যার কতটা ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার পাত্র। পাশাপাশি সাধারণ মানুষদের প্রতিও স্যারের টান কতটা প্রবল তা আমার কাছে স্পষ্ট হয়। এ ঘটনার সাক্ষী না হলে তার সামগ্রিক জীবনের বোধ আমার পক্ষে ধারণ করা সম্ভব হতো না কখনোই। এ জন্যই মনে হয়, এমন একজন মানুষ শারীরিকভাবে আমাদের সামনে থেকে চলে গেলেন, কিন্তু তার জীবন দর্শনের জায়গাটিকে আমরা যদি লালন-পালন করি, তবে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে এসব চেতনা অনেক বৃদ্ধি পাবে।
ইতিহাসের বাঁক বদলের ক্রান্তিকালে আলোর শিখা হাতে রেখেছেন, ঝোড়ো বাতাসেও যে শিখা নেভেনি, আপনার অমিত সাহসের প্রজ্ঞার শিখা অনির্বাণ জ্বলছে, আপনি আমাদের বাতিঘর, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আপনি আমাদের স্মরণের বরণ ডালায় থাকবেন। আপনার প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।