করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে মাস দেড়েক আগে রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ ও বহির্গমন নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ওই ঘোষণা এখন শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। বাস্তব চিত্র হলো, রাজধানীতে প্রবেশের সব পথই এখন উন্মুক্ত। মহানগরে অবাধে মানুষ ও যানবাহন ঢুকছে ও বের হচ্ছে। নেই আগের মতো পুলিশ তল্লাশিও।
সেতু পারাপার না হয়ে নদীবেষ্টিত ঢাকায় যানবাহন প্রবেশ ও বের হওয়ার সুযোগ নেই। করোনা ঠেকাতে 'লকডাউন' জারির পর যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে কাঁচপুর সেতু, পোস্তাগোলা সেতু, বাবুবাজার সেতু, বছিলা সেতু, গাবতলী সেতু, বিরুলিয়া সেতু, টঙ্গী সেতু, কাঞ্চন সেতু ও ডেমরা ব্রিজে পুলিশের চেকপোস্ট বসানো হয়।
চিকিৎসার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি, কৃষিপণ্য, নিত্যপণ্য ও জরুরি পণ্যবাহী গাড়ির যাত্রী ছাড়া আর সব ব্যক্তির প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। রাজধানীতে প্রবেশ ও বের হতে কারণ বলতে হতো। করোনার সংক্রমণ এখনও বন্ধ হয়নি, বরং বাড়ছে। কিন্তু প্রবেশপথে কড়াকড়ি উঠে গেছে।
গতকাল বুধবার বিকেলে গাবতলী সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পুলিশের সেই তল্লাশি চৌকিই নেই। সেতুর দুই প্রান্তে গত মাসে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা পুলিশ পাহারা থাকলেও গতকাল একজনকেও দেখা যায়নি। পায়ে হেঁটে চলা মানুষ, বারোয়ারি যানবাহন সেতু পার হয়ে ঢাকায় ঢুকছে বিনা প্রশ্নে ও তল্লাশিতে। সামাজিক দূরত্ব মেনে না চললেও অধিকাংশ মানুষের মুখে অবশ্য মাস্ক দেখা গেছে।
গাবতলী সেতুর পূর্বপ্রান্তে ঢাকা মহানগর। পশ্চিমে সাভার উপজেলা। পূর্বপ্রান্তে ঢাকা মহানগর পুলিশের আঞ্চলিক ট্রাফিক কার্যালয়। সেখানকার ট্রাফিক আসাদুর রহমান বললেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যখন যেমন নির্দেশ দিচ্ছেন, সেই মোতাবেক তারা কাজ করছেন।
সাভার উপজেলা প্রান্ত থেকে পায়ে হেঁটে গাবতলী সেতু পার হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করা রফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। সাভারের মোগড়াকান্দি গিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে হেঁটে ফিরছেন। রফিকুল বলেন, এখন আর আগের মতো 'চেকিং' নেই। কিছুদিন আগে পুলিশের ব্যাপক চেকিং হতো ব্রিজে। এখন যে কেউ পার হতে পারে।
বিকেল ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত সেতু এলাকায় অবস্থান করে দেখা গেল, বাস বাদে আর সব ধরনের যানবাহন চলছে। কৃষি ও জরুরি পণ্য পরিবহনের অনুমতি থাকলেও সাভার থেকে ইট, বালুবাহী ট্রাক বিনা প্রশ্নে প্রবেশ করছে ঢাকায়। খোলা পিকআপে করে ঢাকার বাইরে থেকে মানুষ ফিরছে ঢাকায়। তবে তাদের সংখ্যা আগের সপ্তাহের তুলনায় অনেক কম।
অভিন্ন চিত্র রাজধানীর বছিলার শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতুতে। এ সেতুটি ঢাকা মহানগরের সঙ্গে কেরানীগঞ্জ উপজেলাকে যুক্ত করেছে। গত মাসে সেতুর পূর্বপ্রান্তে পুলিশের কড়া পাহারা, ব্যারিকেড ছিল। ঢাকায় প্রবেশ কিংবা বের হতে প্রত্যেককে প্রশ্নের মুখে পড়তে হতো। গতকাল বিকেল ৩টার দিকে দেখা যায়, সেখানে পুলিশ তল্লাশির নাম-গন্ধ পর্যন্ত নেই। সেতুর পাশের এক দোকানি জানান, গত ৬ মে থেকেই পাহারা উঠে গেছে। এখন যার ইচ্ছা আসতে পারে। যার ইচ্ছা কেরানীগঞ্জ যেতে পারে। কোনো সমস্যা নেই।
সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ীর সরেজমিন চিত্রও একই রকম। কাঁচপুর সেতুর মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের জেলাগুলো। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের যাত্রীদের বড় অংশ এ পথে চলাচল করেন। করোনা ঠেকাতে ঢাকায় প্রবেশ ও বহির্গমন নিয়ন্ত্রিত করা হলেও সায়েদবাদ, যাত্রাবাড়ীতে এর প্রভাব নেই। প্রাইভেটকার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ছাড়াও পিকআপ, ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশায় ঢাকায় অবাধে প্রবেশ ও বের হচ্ছে মানুষ। ঢাকার কাছাকাছি জেলাগুলো থেকে অল্প হলেও মানুষ যাওয়া-আসা করছে। ভেঙে ভেঙে বিভিন্ন যানবাহনে গন্তব্যে যাচ্ছে। অনেকে মোটরবাইকেও যাতায়াত করছে। তবে কাউকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করতে দেখা যায়নি।
দুপুরে সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী ঘুরে দেখা যায়, দূরপাল্লা ও আন্তঃজেলার সব বাস অলস পড়ে আছে। কিন্তু সড়ক লকডাউনের প্রথমদিকের মতো ফাঁকা নাই। মোড়গুলোতে প্রায় যানজট লাগছে। যাত্রাবাড়ী মোড় রিকশা, সিএনজি ও টেম্পোর দখলে। স্বল্প দূরত্বের শনিরআখড়া, চিটাগাং রোড, ডেমরায় লোকজন টেম্পো অথবা রিকশায় যাচ্ছে। রাইড শেয়ারিং অ্যাপ বন্ধ থাকলেও 'ক্ষ্যাপে' মোটরসাইকেলে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন উপজেলায় যাত্রী পরিবহন চলছে।
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত লোকমান হোসেন বাইকচালকের সঙ্গে দরদাম করে ৬০০ টাকা ভাড়ায় দাউদকান্দির দিকে রওনা হন। তার আগে তিনি বলেন, বাড়ি দাউদকান্দিতেই। জরুরি কাজে মঙ্গলবার ঢাকায় এসেছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে আসা একটি কাভার্ডভ্যানে চালকের পাশে বসে ঢাকায় এসেছিলেন।
সূরক্ষা পোশাকে শরীর আবৃত করা এক যাত্রী নারায়ণগঞ্জ গেলেন ভাড়া বাইকে। তাকে একটু সচেতন মনে হলো। বাইকে চড়ার আগে ব্যাগ থেকে জীবাণুনাশক বের করে বসার সিট ও হেলমেটে স্প্রে করে নিলেন।
ঈদ উপলক্ষে দোকানের জন্য পুরান ঢাকা থেকে পোশাক কিনেছেন ইদ্রিস হোসেন। যাবেন নরসিংদীতে। তিনি জানালেন, ভেঙে ভেঙে যাবেন। রিকশা, টেম্পো যখন যেটা পাবেন, তাতেই রওনা দেবেন। আপতত টেম্পোতে টিচাগাং রোড যাবেন। পাশাপাশি লেগুনায় করে চলে যাবেন। কিন্তু এভাবে গাদাগাদি করে চলাচলে করোনার ঝুঁকি রয়েছে, তা জানেন ইদ্রিস হোসেন। কিন্তু বললেন, এ ছাড়া তার উপায় নেই। খেয়েপরে বাঁচতে হলে দোকান খুলতেই হবে। ঢাকা থেকে মালামাল নিতেই হবে।
মনোয়ার হোসেন নামে এক মোটরসাইকেল চালকের কাছে জানা গেল, অ্যাপ বন্ধ হওয়ায় এখন তিনি নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লায় যাত্রী নিয়ে যান। যাত্রীদের কেউ করোনায় আক্রান্ত কিনা তা জানেন না। পেটের তাগিদের কাছে এত বাছবিচার চলে না।
টঙ্গী (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ঢাকা-গাজীপুর জেলার মধ্যে যান ও মানুষের চলাচলও স্বাভাবিক সময়ের মতোই। টঙ্গী সেতু দিয়ে রোজ সাধারণ যাত্রী ও পোশাক কারখানার শ্রমিকরা ঢাকা থেকে গাজীপুর আসছেন। আবার ঢাকায় ফিরছেন।
গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকা থেকে আব্দুল্লাহপুর চেকপোস্ট দিয়ে হাজার হাজার মানুষ পায়ে হেঁটে টঙ্গী ও গাজীপুরে আসছেন। আবার বিপরীত দিকে টঙ্গী থেকেও হাজারো মানুষ ঢাকায় যাচ্ছেন। কেউ যাচ্ছেন ট্রাকে, পিকআপে, কেউ মাইক্রোবাসে কেউবা পায়ে হেঁটে।
টঙ্গী জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার থোয়াই অংপ্র মারমা বলেন, পোশাক কারখানাগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। সাধারণ যাত্রীসহ পোশাক কারখানার শ্রমিকরা যাতায়াত করছে। বিশেষ করে পোশাক কারখানার শ্রমিকদের গাড়ির পাশাপাশি অল্প কিছু প্রাইভেটকার চলাচল করছে। যে গাড়িগুলো সন্দেহ হচ্ছে, সেগুলোকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।ড়