জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে শায়িত হলেন। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আজিমপুর কবরস্থানে বাবার কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হন তিনি। 

তার ছেলে আনন্দ জামান জানান, আল মারকাজুল ইসলামীর স্বেচ্ছাসেবীরা শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে সিএমএইচ থেকে তার বাবার মৃতদেহ গ্রহণ করেন। পরে কোভিড-১৯ নীতিমালা অনুযায়ী সেখানেই গোসল-কাফনের ব্যবস্থা হয়। জানাজা শেষে সাড়ে ১০টার দিকে আজিমপুর কবরস্থানে বাবাকে সমাহিত করা হয়।

দাফনের আগে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়।

বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত আনিসুজ্জামানের মৃত্যুর পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার কভিড-১৯ টেস্ট করে জানায়, তিনি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন।

করোনার দহন দিনে টালমাটাল দেশ ও বিশ্ব বাস্তবতায় সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই ব্যক্তিত্বের নির্মম অনন্তযাত্রায় দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সব পর্যায়ে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে। শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী, স্পিকারসহ বিশিষ্টজন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও মুহূর্তে তার প্রতি সর্বস্তরের মানুষের শোক প্রতিক্রিয়ায় পূর্ণ হয়ে ওঠে।

২৭ এপ্রিল হৃদরোগ সমস্যার পাশাপাশি কিডনি ও ফুসফুসে জটিলতা, পারকিনসন্স ডিজিজ এবং প্রোস্টেট ও রক্তে সংক্রমণের সমস্যা নিয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে রাজধানীর ইউনিভার্সেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের চিফ কার্ডিওলজিস্ট অধ্যাপক খন্দকার কামরুল ইসলামের অধীনে করোনারি কেয়ার ইউনিটে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। ৯ মে শনিবার তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ফুসফুসের সংক্রমণসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা নিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এর আগে দেশের বাইরে গিয়েও কয়েকবার চিকিৎসা নিয়েছিলেন।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা এটিএম মোয়াজ্জেম ও মা সৈয়দা খাতুন। বাবা ছিলেন বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক আর মা গৃহিণী হলেও লেখালেখির প্রতি ছিল তার আন্তরিক ভালোবাসা। আনিসুজ্জামানের পিতামহ শেখ আবদুর রহিম ছিলেন তার সময়ের একজন বরেণ্য লেখক ও সাংবাদিক।

আনিসুজ্জামানের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কলকাতার পার্ক সার্কাস হাই স্কুলে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে চলে আসার পর খুলনা জিলা স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে ঢাকার প্রিয়নাথ হাই স্কুল (বর্তমান নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও ১৯৫৭ সালে একই বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৫ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৯ সালের জুনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে কাজ শুরু করেন।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্র উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলন, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী আন্দোলন এবং ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করেন এবং পরে ভারত গমন করে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন 'বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি'র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধকালীন গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান ইংরেজিতে প্রণয়নের পর তার দ্রুতগতির বাংলা রূপান্তরের কাজ শেষ করেন এই মনস্বী পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব। ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন তিনি।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত গণআদালতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। আশির দশকে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নাগরিক সমাজের নেতৃত্ব দেন তিনি। ১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব।

আনিসুজ্জামানের উল্লেখযোগ্য রচনাবলির মধ্যে রয়েছে- মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র, স্বরূপের সন্ধানে, আঠারো শতকের বাংলা চিঠি, পুরোনো বাংলা গদ্য, আমার একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর, কাল নিরবধি, বাংলা-ফারসি শব্দসংগ্রহ ও আইন-শব্দকোষ অন্যতম ইত্যাদিসহ প্রায় পঞ্চাশটি গ্রন্থ।

স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধি ও সকল গণতান্ত্রিক-মানবাধিকার প্রশ্নে রুচিশীল আনিসুজ্জামান ছিলেন সুদৃঢ় প্রগতিবাদী ও ন্যায়ের প্রতি অকুণ্ঠ। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে অবিচল ড. আনিসুজ্জামান জাতির বিবেক হিসেবে বহুবার আবির্ভূত হয়েছেন। যে কোনো সরকারের আমলে ঋজু ও অমল কণ্ঠে তিনি মানুষের বাক ও চিন্তার স্বাধীনতার পক্ষে অনড় অবস্থান গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের অজস্র মানুষের সরাসরি শিক্ষক তিনি; তারপরও তার সরাসরি ছাত্র না হলেও বয়স নির্বিশেষে কয়েক প্রজন্মের কাছে তিনি শ্রদ্ধেয় শিক্ষকই ছিলেন। ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় তাকে সবাই 'স্যার' বলে সম্বোধন করেছেন। বহু বিচিত্র শ্রেণি-পেশার মানুষ তার কাছে বরাবর পেয়েছেন সুস্মিত প্রশ্রয়, উদার অভিভাবকত্ব। বিশেষত গত পাঁচ দশকের বাংলাদেশে সব প্রজন্মের লেখক, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিক কর্মীর আস্থা ও ভরসাস্থল ছিলেন আনিসুজ্জামান। সবার মতামত শোনার মতো বিবেচনা ও প্রজ্ঞা তার ছিল। নিজের বক্তব্য প্রকাশে তিনি সারাজীবন কখনোই তথ্যবিকৃতি বা একপেশে মন্তব্য করেননি। জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি মার্জিত ব্যবহার, ভদ্রতা, পরিমিতি ও বিবেচনাবোধের অতুলনীয় এক উদাহরণ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। পরিমিতি ও তথ্য-উপাত্তে তার তুল্য ব্যক্তি পুরো উপমহাদেশেই বিরল। 'আমার অভিধান' নামে তিনি আঙ্গিকে হ্রস্ব অথচ প্রয়োজনীয় এক অভিধান রচনা করেন।

অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও ১৯৮৫ সালে একুশে পদক লাভ করেন। এ ছাড়া জীবনজুড়ে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ আরও পেয়েছেন অলক্ত পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার। এ ছাড়া রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রিতে ভূষিত হয়েছেন। তিনি ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা 'পদ্মভূষণ' অর্জন করেন। এ ছাড়া তিনি ১৯৯৩ ও ২০১৭ সালে দু'বার আনন্দবাজার পত্রিকা কর্তৃক প্রদত্ত আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেয়।