সুন্দরবন হয়ে স্থলভাগে উঠে আসার পর যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গাসহ ওই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ জনপদে বুধবার রাতে তাণ্ডব চালিয়েছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। অথচ ঝড়ের কোনো পূর্বাভাসই ছিল না সেখানকার জেলাগুলোতে। স্থলভাগে উঠে আসার পর ঘূর্ণিঝড়টি সাতক্ষীরা থেকে উত্তর দিকে অগ্রসর হবে- আবহাওয়া অধিদপ্তরের এমন পূর্বাভাস থাকলেও স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা না থাকায় এসব জেলার মানুষকে ঝড়ের আঘাত হানার বিষয়ে সতর্ক করা হয়নি। ফলে যশোরে গাছচাপায় ছয়জনের প্রাণহানিসহ আশপাশের জেলাগুলোতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

আম্পানের বিষয়ে ৩৮টি বিশেষ বুলেটিন প্রচার করেছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। প্রত্যেকটিতে ঝড়ো হাওয়ার সতর্কতা ছিল। তবে ঘুরেফিরে সেই সতর্কবার্তা ছিল কেবল উপকূলের ১৪টি জেলা ঘিরে। আম্পানের তাণ্ডব শুরুর পর দেখা যায়, ওই ১৪ জেলার মধ্যে কয়েকটিতে তেমন আঁচই লাগেনি। অন্যদিকে, সতর্কবার্তা দেওয়া হয়নি, এমন কয়েকটি জেলা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় নিম্নচাপে পরিণত হয় আম্পান। সন্ধ্যা ৬টায় এটি অবস্থান করছিল নওগাঁয়। গতকাল রাতের মধ্যেই লঘুচাপে পরিণত হয়ে শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি ঝরিয়ে বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা আম্পানের। তখনও সমুদ্রবন্দরগুলোতে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত জারি ছিল। শক্তি হারিয়ে উপকূলীয় জেলাগুলো থেকে অনেক দূরে সরে গেলেও বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায়ও ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি থাকার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

এ বিষয়ে আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান সমকালকে বলেন, যেহেতু ঘূর্ণিঝড় উপকূল হয়ে ঢোকে, সেজন্য বিবেচনায় উপকূলীয় জেলাগুলো থাকে। এ ছাড়া মূলত বন্দরকেন্দ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সতর্ক সংকেত দেওয়া হয়ে থাকে। যশোর-ঝিনাইদহ অঞ্চলের জন্য আলাদা সতর্কবার্তা দেওয়া না হলেও ঘূর্ণিঝড়টি উত্তর দিক হয়ে অতিক্রম করবে, এমন নির্দেশনা ছিল।

অন্যদিকে, বুধবার আম্পান বাংলাদেশের স্থলভাগে প্রবেশ করার আগে আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বক্তব্যে অনেক গরমিল চোখে পড়ে। তাদের কেউ বলছিলেন সাতক্ষীরার স্থলভাগে প্রবেশ করার পর আম্পানের স্থায়িত্ব হবে চার ঘণ্টা, কেউ বলছিলেন আট ঘণ্টা। বিভিন্ন গণমাধ্যমে একেকরকম তথ্য প্রচারের কারণে বিভ্রান্তিতে পড়ে মানুষ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আম্পানের ব্যাস ছিল প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। আর সাতক্ষীরা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব প্রায় ৫০০ কিলোমিটার। এ কারণে সাতক্ষীরা অতিক্রম করার সময় ঝড়ের প্রভাব চট্টগ্রাম পর্যন্ত পড়েনি। কক্সবাজারের টেকনাফ তো আরও দূরে। কিন্তু চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে আম্পান নিয়ে যে তোড়জোড় ছিল, তার ছিটেফোঁটাও ছিল না যশোর-ঝিনাইদহের দিকে। এর পরিণতিও এখন স্পষ্ট।

গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, আবহাওয়া অধিদপ্তর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। তারা কেবল বন্দরকেন্দ্রিক সতর্কবার্তায় আটকে ছিল। উপকূলীয় জেলাগুলোর পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় যে রুট হয়ে অতিক্রম করবে, তার আশপাশের এলাকাগুলো তাদের ভাবনাতেই ছিল না।

তিনি মনে করেন, আবহাওয়া অধিদপ্তর আম্পানের গতিবিধি বুঝতেই পারেনি। এর প্রভাব বিভিন্ন অঞ্চলে পড়েছে। তাদের উচিত ছিল ঘূর্ণিঝড়ের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করে সংশ্নিষ্ট এলাকাগুলোতে সতর্কবার্তা পাঠানো।

সতর্কবার্তা না থাকার মাশুল সবচেয়ে বেশি দিয়েছে যশোর। বুধবার মধ্যরাত থেকে প্রবল বেগে ঝড় বইতে শুরু করে এ জেলায়। এর প্রভাবে গাছচাপায় ঘুমন্ত মা-মেয়েসহ ছয়জনের মৃত্যু হয়। যশোরে ঝড়ের কোনো পূর্বাভাস ছিল না বলে স্বীকার করেন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মুহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, উপকূলীয় এলাকায় যেমন ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, সে রকম সতকর্তা থাকলে প্রাণহানি এড়ানো যেত।

পাবনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা রেজাউল করিমও জানান, তাদের কাছে আবহাওয়া অধিদপ্তরের কোনো সতর্কবার্তা ছিল না। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর এবং নিজস্ব সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আম্পানের গতিপথ নিয়ে ধারণা পান। সে অনুযায়ী মোবাইল ফোনে বিভিন্ন এলাকায় সতর্কবার্তা পৌঁছান। ঘূর্ণিঝড়ে পাবনায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।