ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবে ২৬টি জেলায় এক হাজার ১০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। চারটি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া প্রাথমিক হিসাবে এ ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। চূড়ান্ত হিসাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। আম্পানের আঘাতে প্রাণ গেছে ১০ জনের।
গতকাল বৃহস্পতিবার অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়ে দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান জানিয়েছেন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং কৃষি মন্ত্রণালয় ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক হিসাব দিয়েছে। এই চার মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী এক হাজার ১০০ টাকার সম্পদ ও ফসলের ক্ষতি হয়েছে। অন্যান্য মন্ত্রণালয় প্রতিবেদন দিলেও তাদের হিসাবে তেমন ক্ষতি হয়নি। তবে সারাদেশে মোট ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত ও প্রকৃত ক্ষতির হিসাব পেতে অন্তত সাত দিন সময় লাগবে। এদিকে পৃথক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, আম্পানের আঘাতে এক লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সাতক্ষীরায়। ধানের খুব বেশি ক্ষতি না হলেও আমের বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের খবর অনুযায়ী, অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পানে আরও ক্ষয়ক্ষতি হতে পারত। কিন্তু সুন্দরবন সেই ক্ষতি থেকে আমাদের রক্ষা করেছে। আম্পান সুন্দরবনে আঘাত করায় বড় ধরনের ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছে উপকূল। সুন্দরবনের কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা নির্ধারণে চারটি কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মো. শাহাবউদ্দিন।
কৃষকরা ক্ষতিপূরণ পাবেন : কৃষিমন্ত্রী জানিয়েছেন, ফসলের ক্ষতির হিসাব এখনও টাকার অঙ্কে করা যায়নি। তবে বোরো ধানের মতো প্রধান ফসলের খুব বেশি ক্ষতি হয়নি জানিয়ে আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, সাত-আট দিন আগেও যদি এই ঝড় হতো, তাহলে কৃষিতে আরও বেশি ক্ষতি হতো। যতটুকু ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল, তার চেয়ে কম ক্ষতি হয়েছে। গত ১৫ মে আম্পান মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল দ্রুত ফসল তুলতে। এসব কারণে ক্ষতি কম হয়েছে।
কৃষিমন্ত্রী জানান, ফসলের ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন আগামী দু-তিন দিনে পাওয়া যাবে। টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে কৃষকদের ক্ষতি পোষানোর ব্যবস্থা করা হবে। গ্রাম গ্রাম ধরে যার যেমন ক্ষতি হয়েছে তাকে তেমন ক্ষতিপূরণ দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।
হাজার কোটি টাকার ক্ষতি :ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী জানান, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২৬টি জেলায় ১১০০ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ২০০টি ব্রিজ-কালভার্ট ও ২৩৩টি স্থানীয় সরকার কার্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া অনেকগুলো টিউবওয়েলের ক্ষতি হয়েছে।
প্রতিমন্ত্রী আরও জানান, বরিশাল ও খুলনা বিভাগে পাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া আম, লিচু, মুগ ডালের ক্ষতি হয়েছে। প্রায় ১৫০ কোটি টাকার আমের ক্ষতি হয়েছে। সাতক্ষীরা, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। ধানের তেমন ক্ষতি হয়নি। তিনি জানান, জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দেওয়া হবে, আমচাষিদের যেন বিশেষ সহায়তা দেওয়া হয়। এতে তারা কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন।

ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী ১৫০ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৮৪টি জায়গায় বাঁধের ফাটল ধরেছে বা ভেঙেছে। এর সংস্কারে ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে এনামুর রহমান জানান, গবাদিপশুর খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে মৎস্য চাষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালীতে প্রায় এক লাখ ৮০ হাজার ৫০০ চিংড়ি ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য ৩২৫ কোটি টাকা।

এনামুর রহমান জানান, শিক্ষা খাতের খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সামান্য ক্ষতি হয়েছে, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো ক্ষতি হয়নি।

প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি ঠিক করতে উপদ্রুত প্রতিটি জেলায় ৫০০ বান্ডিল টিন ও ১৫ লাখ করে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ত্রাণের জন্যও চাল ও নগদ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

সুন্দরবনের ক্ষতি খুঁজতে কমিটি :পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সুন্দরবনের ক্ষতি নিরূপণে চারটি কমিটি করা হয়েছে। আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিগুলোকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।

পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী এক ভিডিও বার্তায় জানান, প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুন্দরবনে বন বিভাগের ১০টির বেশি কাঠের জেটি এবং ৩০টির বেশি স্টাফ ব্যারাকের টিনের চাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে বনবিভাগের ৬০টির বেশি পুকুরে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করেছে। সুন্দরবনের গাছগাছালির মধ্যে কেওড়া গাছ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত অথবা ভেঙে যাওয়া গাছপালা অপসারণ করা হবে না। সুন্দরবন নিজস্ব প্রাকৃতিক ক্ষমতা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনবে।

ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শাহ কামাল সমকালকে জানিয়েছেন, আম্পানে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রয়োজনীয় ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হবে। পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ রয়েছে। করোনা সংকট ও আম্পানের ত্রাণ কার্যক্রম একই সঙ্গে চলবে।