অভাব-অনটনের সংসার ফিরোজ হাওলাদারের। পেশায় তিনি রংমিস্ত্রি। চার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে হাতিরঝিল থানাধীন মিরবাগ এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। 'লকডাউন' পরিস্থিতিতে হাতে অনেকদিন কোনো কাজও নেই ফিরোজের। আত্মীয়স্বজন আর প্রতিবেশীদের টুকটাক সহায়তায় কোনোমতে চলছিল সংসার। এমন বাস্তবতায় গত বুধবার চার বছরের ছোট ছেলে সিফাতকে হঠাৎ 'হারিয়ে' পাগলগ্রায় হয়ে পড়েন ফিরোজ ও তার স্ত্রী। কিছু সময় পরপরই তার ফোনে অজ্ঞাত একটি নম্বর থেকে কল আসে। ফোনের ওপাশ থেকে বলা হয়, 'সিফাতকে অপহরণ করা হয়েছে। ৫০ হাজার টাকা দিলে শিশুটিকে ফেরত দেওয়া হবে। পুলিশকে জানালে বা কোনো চালাকি করলে লাশও খুঁজে পাওয়া যাবে না।'

এ ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে পূর্বপরিচিত মিলন নামের এক ব্যক্তি এই অপহরণের সঙ্গে জড়িত। মিলন ছিল রংমিস্ত্রি ফিরোজের সহকারী। ফিরোজের বাসায় মিলনের প্রায়ই যাতায়াত ছিল। শিশু সিফাত কচি-মিষ্টি কণ্ঠে মিলনকে 'মিলন মামা' বলে ডাকত। অপহরণের পর সেই প্রিয় মিলন মামার ভয়ংকর রূপ দেখল শিশুটি।

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাফিজ আল ফারুক জানান, বুধবার সকাল ১১টার দিকে বাসার সামনেই খেলছিল সিফাত। ত্রাণ হিসেবে পাওয়া আটা দিয়ে সিফাতের জন্য রুটি বানাচ্ছিলেন তার মা। কাজ না থাকায় বাসায় শুয়ে ছিলেন ফিরোজ। ছেলেকে না পেয়ে হঠাৎ স্ত্রীর চিৎকারে তার ঘুম ভাঙে। ছুটে আসেন প্রতিবেশীরা। সবাইকে নিয়ে আশপাশের রাস্তাঘাট, বাসাবাড়িতে তন্নতন্ন করে সিফাতকে খোঁজা হয়। দুপুর সোয়া ১টার দিকে একটি অজ্ঞাত নম্বর থেকে সিফাতের বাবার মোবাইল ফোনে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তার। কোথায় কীভাবে ৫০ হাজার টাকা জোগাড় করবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না তিনি। এরপর পুরো বিষয়টি হাতিরঝিল থানার ওসি আব্দুর রশীদকে জানিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন সিফাতের বাবা। ছেলের অপহরণের কথা পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছেন স্বামী- এটা জানার পর শিশুটির মা অজানা শঙ্কায় অচেতন হয়ে পড়েন। তার আশঙ্কা ছিল, অপহরণকারীরা এ খবর জানতে পারলে তার ছেলেকে মেরে ফেলবে।

পুলিশ জানায়, তদন্তের শুরুতে তার মা-বাবার কাছ থেকে সিফাতের একটি ছবি সংগ্রহ করে পুলিশ। পুলিশের পরামর্শে অপহরণকারীদের সঙ্গে মুক্তিপণ দেওয়ার ব্যাপারে দেনদরবার চালাতে থাকে ফিরোজ হাওলাদার। সামান্য হেরফের হলেই সিফাতের ছিন্নভিন্ন লাশ বস্তাবন্দি  করে নদীতে ফেলে দেওয়ার হুমকি আসে ফোনের ওপাশ থেকে।

কৌশলে অপহরণকারীদের তাড়া করে ডেমরা, মিরপুর, সাভার হয়ে বুধবার রাত ১১টার দিকে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটে পৌঁছে হাতিরঝিল থানা পুলিশের টিম। এসআই শরিফুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশের ওই টিম রাত পৌনে ১২টায় পাটুরিয়া ঘাট এলাকা থেকে উদ্ধার করে সিফাতকে।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাফিজ আল ফারুক জানান, মিলনের সঙ্গে তার এক সহযোগী থাকতে পারে। তারা শিশুটিকে নিয়ে একাধিকবার লোকেশন পরিবর্তন করে। শেষ পর্যন্ত পাটুরিয়া হয়ে ফরিদপুর যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল। পাটুরিয়া গিয়ে দেখে ফেরি বন্ধ। সেখানে হাজার হাজার মানুষ। এ ছাড়া ফরিদপুরে সম্ভাব্য যেখানে যাচ্ছিল, সেখানেও স্থানীয় পুলিশ আগে থেকে ফাঁদ পেতে রাখে। এ বিষয়টি অপহরণকারীরা টের পায়। এসব কারণে শিশুটিকে পাটুরিয়া ঘাটে একটি টংঘরে রেখে পালিয়ে যায় তারা। অপহরণকারীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। শিশুটিকে শনাক্ত করার জন্য পুলিশের কাছে শুধু ছিল তার মা-বাবার কাছ থেকে পাওয়া একটি সাদা-কালো ছবি। টংঘরে শিশুটিকে ঘুমন্ত অবস্থায় পাওয়ার পর প্রথমে ওই ছবির সঙ্গে মেলানো হয়। পরে বাবাকে ডেকে আনার পর তার ডাকে সিফাতের ঘুম ভাঙে। বাবাকে দেখেই তার কোলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে।