করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে দীর্ঘ ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটির পর গতকাল রোববার খুলেছে অফিস-আদালতসহ সরকারি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান। চলেছে ট্রেন, লঞ্চ। আজ থেকে চলবে বাসও। জীবন বাঁচাতে জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়ে সব খুলে দেওয়া হলেও করোনা আতঙ্ক সর্বত্র। গতকাল রেকর্ড মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যায় মানুষ আরও শঙ্কিত। সামাজিক দূরত্বসহ স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার শর্তে 'সীমিত পরিসরে' সব খুললেও সড়ক, বাজারসহ অধিকাংশ স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এর ফলে সংক্রমণ পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।
করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে গত ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। পরে তা বাড়ে সাত দফা, যা পরিচিতি পায় লকডাউন নামে। বন্ধ হয়ে যায় সব অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন, বিপণিবিতান। ১০ মে থেকে সীমিত পরিসরে বিপণিবিতান খোলা হয়। গতকাল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকি প্রায় সবকিছু খুলে দেওয়া হয়। আজ সোমবার থেকে ৬০ শতাংশ বাড়তি ভাড়ায় চলবে যাত্রীবাহী বাস।
অফিস খুলছে, ভিড় কম :কয়েক দফায় নির্দিষ্ট কয়েকটি মন্ত্রণালয় খোলার পর গতকাল পুরোপুরি খুলেছে প্রশাসনের কেন্দ্রস্থল সচিবালয়। তবে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে সচিবালয়ে দর্শনার্থী পাস বন্ধ থাকায় আগের মতো ভিড় ছিল না।
সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী আগের মতোই কর্মচারীরা সচিবালয়ের স্টাফবাসে কর্মস্থলে আসেন। সচিবালয়ে প্রবেশের সময় গেটে দায়িত্বরত ডাক্তার-নার্সরা তাপমাত্রা মাপেন কর্মচারী-কর্মকর্তাদের। সবাই মাস্ক ও গ্লাভস পরা ছিলেন।
স্বাস্থ্যবিধি মেনেই মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিবরা যথারীতি তাদের অফিসে বসে দাপ্তরিক কার্যক্রম চালিয়েছেন। কোনো কোনো মন্ত্রী কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আবার অনেকেই সাংবাদিকদের সঙ্গে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে ভার্চুয়াল ব্রিফিং করেছেন।
অফিস খোলার পর সবগুলো ভবনের মেঝেতে জীবাণুনাশক ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন স্থানে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখা ছিল। বসানো হয়েছে জীবাণুনাশক টানেল। চার নম্বর ভবনের চতুর্থ তলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েও জীবাণুনাশক টানেল বসানো হয়েছে। সচিবালয়ে গাড়ি রাখার স্থানগুলো আগের মতোই পূর্ণ দেখা যায়। একাধিক কর্মকর্তা জানান, করোনার মধ্যে ১৮টি মন্ত্রণালয়ের অফিস খোলা ছিল। বাকিগুলো ছিল বন্ধ। যে কারণে বন্ধ থাকা মন্ত্রণালয়ের কমন টয়লেটগুলো ছিল বেহাল।
সড়কে স্বাস্থ্যবিধি, ভিড়, আতঙ্ক, বিশৃঙ্খলা সবই আছে :গতকাল ঢাকার সড়কে বেড়েছে মানুষের ভিড়। সরেজমিনে দেখা যায়, করোনাকালের আগের কর্মচাঞ্চল্য না ফিরলেও গত কয়েক সপ্তাহের তুলনায় বহুগুণ বেশি মানুষ পথে নেমেছে। সড়কের পাশে ফুটপাতে ফের বসেছে দোকান। মোড়গুলোতে মানুষের ভিড়। রিকশা-অটোরিকশার জন্য প্রতীক্ষা। কোথাও কোথাও ভিড় ছিল ত্রাণের জন্য।
গতকাল সকাল ১১টায় এবং বিকেল সাড়ে চারটায় মোটরসাইকেলে জিগাতলা থেকে সায়েন্সল্যাব, নীলক্ষেত, শাহবাগ, হাইকোর্ট, পল্টন, সচিবালয়, দিলকুশা, মতিঝিল, ফকিরাপুল, বিজয়নগর, কাকরাইল, বাংলামটর, কারওয়ানবাজারের সার্কফোয়ারা, ফার্মগেট, বিজয়সরণি, মানিক মিয়া এভিনিউ, ধানমন্ডি ২৭ নম্বর, মোহাম্মদরপুর, বছিলা এলাকা ঘুরে ভিন্ন ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। ধানমন্ডির আবাসিক এলাকায় দেখা গেছে, এখনও সড়কগুলো বাঁশ দিয়ে অবরুদ্ধ। আবার মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় দেখা গেছে সামাজিক দূরত্বের কোনো বালাই নেই।
সকালের দিকে সড়ক প্রায় ফাঁকা ছিল। কোথাও সিগনালে পড়তে হয়নি। বিকেল কারওয়ানবাজারের সার্ক ফোয়ারা থেকে ফার্মগেট হয়ে বিজয়সরণি পর্যন্ত ছিল প্রাইভেট, মাইক্রোবাস এবং অফিসের কর্মীদের বাসের ভিড়। দীর্ঘ যানজট। কারওয়ানাবাজারে পিপিই পরে দায়িত্ব পালন করছিলেন ট্রাফিক পুলিশ সদস্য আক্তার হোসেন। তিনি জানালেন, দীর্ঘ আড়াই মাস পর সিগনাল ফেলতে হচ্ছে। গাড়ির খুব চাপ। একটু পর পর যানজট হচ্ছে।
ফার্মগেটের যানজটে জানালা দিয়ে কথা হয় ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কর্মীবাহী বাসের যাত্রীদের সঙ্গে। বাসটিতে তারা একটি করে আসন ফাঁকা রেখে বসেছেন। বিভিন্ন অফিসের লোগো লাগানো বাসে ও গাড়িতে সামাজিক দূরত্ব মেনে যাত্রী পরিবহন করেছে। তবে ভিন্ন চিত্রও ছিল। কয়েকটি মাইক্রোবাসে গাদাগাদি করে লোক নিতে দেখা যায়।
বিকেলে সচিবালয়ের সামনে দেখা গেল, অফিস শেষে মানুষের ভিড়। আবদুল গণি সড়কে রাখা গাড়িতে যানজট সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু অদূরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সুপ্রিম কোর্ট এলাকা ছিল সুনসান নীরব। খবর নিয়ে জানা গেল, গুলশানের বাণিজ্যিক অংশ বাদে আবাসিক এলাকাতেও ছিল একই রকম নীরবতা।
বাস চালু না হওয়ায় গতকাল সড়কে হেঁটে চলা মানুষের সংখ্যা ছিল অস্বাভাবিক রকমের বেশি। করোনার কারণে বড় পরিবর্তন হলো, বাইরে বের হওয়া অধিকাংশ মানুষের মুখে ছিল মাস্ক। কেউ কেউ গ্রীষ্ফ্মের গরমেও কমদামি 'পিপিই' পরে বাইরে বের হচ্ছেন।
তবে ভিন্ন চিত্রও ছিল। মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগের বেড়িবাঁধ এলাকায় পিপিই দূরে থাক, মাস্ক পরা লোকজনই বিরল। সিকদার মেডিকেলের সামনে ভ্যানে লিচু বিক্রি করা আবুল কাশেম নির্বিকার মনে বললেন, গরিবের করোনা হয় না। আর হলেও এই গরমে সারাক্ষণ মাস্ক পরা সম্ভব না।
অ্যাপে গাড়ি, মোটরসাইকেল ভাড়া বন্ধ থাকলেও গতকাল ঢাকার সড়কে দেখা গেছে চুক্তিতে যাত্রী বহন করছে মোটরসাইকেল। এই বাহনটিতে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা সম্ভব না হলেও অটোরিকশার ভাড়া বেশি হওয়ায় অনেকেই বাইকে চড়ছেন।
ট্রেন এলো সামাজিক দূরত্ব মেনে : গতকাল প্রথম দিনে আটটি আন্তঃনগর ট্রেন ঢাকায় এসেছে। বিকেলে ও রাতে এগুলো আবার ফিরে যায়। বিকেলে কমলাপুর স্টেশন পরিদর্শনে যান রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। তিনি বলেছেন, যাত্রী পরিবহনে স্বাস্থ্যবিধির ব্যত্যয় হয়নি। ৫০ ভাগ আসন খালি রেখে ট্রেন চলছে। কোথাও একজনও বাড়তি যাত্রী তোলার অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
ঢাকা থেকে যারা বিভিন্ন জেলায় গিয়েছেন ট্রেনে ওঠার আগে তাদের শরীরের তাপমাত্রা মাপা হয়। স্টেশনে প্রবেশ করতে হয় সামাজিক দূরত্ব মেনে। প্রথম দিনে ঢাকায় আসা যাত্রীরা জানিয়েছেন, ট্রেনে সামাজিক দূরত্ব মেনেই যাত্রী পরিবহন করা হয়েছে।
বাসে চলছে ঘষামাজা : সবকিছু গতকাল খুললেও আজ থেকে চলবে যাত্রীবাহী বাস। গতকাল সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় বাসের ভাড়া ৬০ ভাগ বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। দূরপাল্লা ও নগর পরিবহন সব ধরনের বাসেই এ ভাড়া বাড়বে। শর্ত হিসেবে বাসে অর্ধেক সিট খালি রাখতে হবে। মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি।
গতকাল মহাখালী টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, বাস মেরামত করার কাজ চলছে। শাহজালাল পরিবহনের চালক নয়ন মিয়া জানান, দুই মাস বসে থেকে তার বাসের ব্যাটারি নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক বাসের চাকা বসে গেছে। এগুলো মেরামত করা হচ্ছে। ধোয়ামোছা চলছে সব বাস।
দোকানে এখনও ক্রেতা নেই : বিপণিবিতান খুললেও দোকানগুলোতে এখনও ক্রেতা নেই বললেই চলে। এলিফ্যান্ট রোডের প্রিয়প্রাঙ্গণ মার্কেটের ব্যবসায়ী কাওসার জামান জানালেন, ঈদের পর এমনিতেই ক্রেতা কম থাকে। কিন্তু গতকাল বিকেল ৪টায় দোকান বন্ধ করার আগ পর্যন্ত একজন ক্রেতাও আসেননি। তবে পাড়া-মহল্লার মুদি দোকান ও কাঁচাবাজারে ভিড় রয়েছে।
সিদ্ধান্ত বিজ্ঞানসম্মত নয়, সংক্রমণ আরও বাড়বে- মত বিশেষজ্ঞদের :বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক সমকালকে বলেন, অফিস-আদালতসহ সবকিছু খুলে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত বিজ্ঞানসম্মত নয়। একইভাবে এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শের পরিপন্থি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, সংক্রমণ কমলে পরিকল্পনা করে ধাপে ধাপে লকডাউন তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। ইতালি, স্পেনসহ অন্য দেশগুলো সেটিই করেছে। ওইসব দেশ ধাপে ধাপে লকডাউন প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। কিন্তু সর্বোচ্চ সংক্রমণের সময় বাংলাদেশে হঠাৎ করে সবকিছু চালু করার সিদ্ধান্ত হলো। কার বা কাদের পরামর্শে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে জানি না। তবে এটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে সারাদেশের মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হলো। সংক্রমণ মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছাবে এবং সার্বিকভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ পড়বে। কিন্তু সেই চাপ সামাল দেওয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার নেই।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব সমকালকে বলেন, সবকিছু খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত পুরো জনগোষ্ঠীকে চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেবে। সবকিছু খুলে দিয়ে আবার বলা হলো, সীমিত পরিসরে। কিন্তু সবকিছু চলছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। তাহলে সীমিত কোথায় থাকল? সীমিত কথার মানে কী? সীমিত বললে কি রোগটি কম ছড়াবে? অফিসে আসা-যাওয়ায় মানুষ কীভাবে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করবেন? এভাবে হবে না। মানুষ পরস্পরের সংস্পর্শে গিয়ে রোগটির সংক্রমণ আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে। তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।