
লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যাকাণ্ডের মামলাগুলোর তদন্তে মানব পাচারের চাঞ্চল্যকর তথ্য পাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ঢাকা থেকে শুরু করে লিবিয়া পর্যন্ত নানা রুটে পাচারের শিকার ব্যক্তিরা নানা ঘাটে পাচারকারীদের হাতে কীভাবে বিক্রি হন, সে তথ্যও বেরিয়ে আসছে। এই পাচার, নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায়ের সঙ্গে যুক্ত দালাল চক্রের কার্যক্রমের চাঞ্চল্যকর তথ্য এখন গোয়েন্দাদের হাতে। এসব তথ্যের সূত্র ধরে পাচারকারীদের পুরো জালের সন্ধানে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সংস্থা।
লিবিয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকার তেজগাঁও থানায় করা একটি মামলার তদন্ত সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, গ্রামে গ্রামে স্থানীয় দালাল চক্র ইউরোপে সুন্দর জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে তরুণদের আকৃষ্ট করে। এরপর তাদের মিথ্যা আশ্বাসে নানা রুট দিয়ে ঢাকা থেকে দুবাই পাঠানো হয়। ঢাকা থেকে পাচারকারী চক্র ওই তরুণদের দুবাইয়ে অবস্থানকারী চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়। ঢাকা থেকে বিশেষ রংয়ের টি-শার্ট পরিয়ে তাদের বিমানে তোলা হয় অথবা দুবাই বিমানবন্দরে নেমে দালালদের সরবরাহ করা বিশেষ রংয়ের টি-শার্ট পরেন পাচার ব্যক্তিরা।
রং দেখেই দুবাইয়ে অবস্থান করা চক্র তাদের রিসিভ করে নিজস্ব ক্যাম্পে নিয়ে যায়। চক্রটি সুবিধামতো সময়ে পাচার হওয়া ব্যক্তিদের জর্ডানের রাজধানী আম্মানে অবস্থান করা সিন্ডিকেটের কাছে বিক্রি করে দেয়। তখন আবার তাদের ভিন্ন রংয়ের টি-শার্ট পরতে দেওয়া হয়। আম্মানের চক্রটি রং দেখে তাদের রিসিভ করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাদের পাচার করা হয় লিবিয়ায়। তখনও দুই দেশের (জর্ডান-লিবিয়া) সিন্ডিকেটের সদস্যরা পাচার হওয়া ব্যক্তিদের আবার অন্য রংয়ের গেঞ্জি বা টি-শার্ট পরায়। এই রং দেখেই লিবিয়ার চক্র তাদের রিসিভ করে ক্যাম্পে নেয়।
লিবিয়া ক্যাম্পে নেওয়ার পর এই তরুণদের কাছে ইতালি যাওয়ার জন্য অতিরিক্ত টাকা দাবি করা হয়। নানাভাবে জিম্মি করে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনের কাছ থেকে এ টাকা আদায় করা হয়। যাদের কাছ থেকে টাকা পাওয়া হয়, তাদেরই ঝুঁকিপূর্ণ নৌপথে ইতালির উদ্দেশে পাচার করা হয়। টাকা না পেলে চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। নির্যাতন করে গ্রামে থাকা স্বজনদের তা মোবাইলে ভিডিওকলে দেখানো হয়। আবার কখনও বলা হয়, লিবিয়ার ক্যাম্প থেকে স্থানীয় মাফিয়ারা তাদের অপহরণ করে নিয়ে গেছে। তাদের উদ্ধারের জন্য টাকা দিতে হবে। এভাবে লাখ লাখ টাকার মুক্তিপণ আদায় করা হয়।
তেজগাঁও থানায় এ মামলার তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহাদত হোসেন সোমা সমকালকে বলেন, মামলায় তারা পাচারকারী চক্রের এ দেশীয় এজেন্ট সুজন ও কাওসার নামে দু'জনকে গ্রেপ্তার করেছেন। এর মধ্যে সুজন আদালতে জবানবন্দি দিয়ে পাচারের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। কাওসারকেও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য মিলেছে।
তিনি বলেন, সুজন ও কাওসারের চক্রটি ইউরোপ যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের ঢাকা থেকে কৌশলে প্রথমে দুবাইয়ে পাচার করে। সেখানে আফ্রিন আহমেদ নামের এক সদস্য তাদের রিসিভ করে। ওই সময় তাদের (পাচার হওয়া ব্যক্তিদের) নীল রংয়ের টি-শার্ট পরিয়ে দেওয়া হয়। নীল টি-শার্ট পরা থাকলেই আফ্রিন বুঝতে পারে, এরা তার লোক। সেখান থেকে তাদের আম্মানে পাঠানো হয়। এরপর তাদের হালকা সবুজ রংয়ের গেঞ্জি পরিয়ে জর্ডানের সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেখান থেকে তাদের নেওয়া হয় লিবিয়া। ওই সময়ে তাদের সাদা-কালো রংয়ের টি-শার্ট পরানো হয়।
গ্রেপ্তার সুজন ও কাওসার জানিয়েছে, লিবিয়ার এয়ারপোর্টে দেশটির সিন্ডিকেটের সদস্যরা ছাড়াও তাদের নিয়োগ করা সজীব, মানিক এবং জাফর অবস্থান করে। সাদা-কালো গেঞ্জি দেখলেই তারা বুঝতে পারে, এই ব্যক্তিরা তাদের মক্কেল। পরে তাদের নিজস্ব ক্যাম্পে নেওয়া হয়। লিবিয়া থেকে সুবিধাজনক সময়ে সিন্ডিকেটকে টাকা দিয়ে নৌকা বা স্পিডবোটে মাল্টা দিয়ে অবৈধভাবে ইতালিতে লোক পাচার করে আসছিল তারা।
ডিবির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা সুজন একসময় এই রুট দিয়েই ইতালিতে গিয়েছিল। পরে সে দেশে এসে মানব পাচারে যুক্ত হয়ে পড়ে। তার আপন ভাই সজীব বর্তমানে লিবিয়া অবস্থান করছে। সুজনের হয়ে সজীবই পাচার চক্রের আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেটটি সমন্বয় করে থাকে।
এদিকে ফরিদপুরের মানব পাচারকারী মোশারফ মিঞা ইতালিতে পাচারের উদ্দেশে অর্ধশত তরুণকে গত ছয় মাস ধরে দুবাইয়ে একটি ক্যাম্পে আটকে রেখেছে। ক্যাম্প থেকে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ না করে অন্তত তিনজন জিম্মি গোপনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা জানিয়েছেন, অন্তত ছয় মাস ধরে তাদের আটকে রেখেছে। পাসপোর্ট নিয়ে নেওয়ায় তারা বের হতে পারছেন না। তাদের শারীরিক নির্যাতন করা না হলেও ঠিকমতো খাবার দেওয়া হচ্ছে না। দুটি ছোট্ট কক্ষে অন্তত ৪০ জন লোক অবস্থান করছেন।
ওই তিনজন জানান, এরই মধ্যে দুবাইয়ে অবস্থানরত স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনেকেই ক্যাম্প থেকে পালিয়েছেন। তারা বিষয়টি বাংলাদেশ দূতাবাসকেও জানিয়েছেন। কিন্তু তাদের স্বজন না থাকায় ক্যাম্পেই বন্দি রয়েছেন। সবকিছু বিক্রি করে ফরিদপুরের মোশারফকে টাকা দিয়ে এখন দেশেও ফিরতে পারছেন না, তাদের ইতালিও পাঠানো হচ্ছে না।
মন্তব্য করুন