'তিনি বৃদ্ধ হলেন... বৃদ্ধ হলেন.../ বনস্পতির ছায়া দিলেন সারাজীবন।/ এই বুড়ো গাছের পাতায় পাতায়/ সবুজ কিন্তু আজো মাতায় সুঠাম ডালে'- সম্বোধন করতে হয় না, বাবার কথাই সবার মনে পড়ে যায় কবির সুমনের এ গানে। বাবা সন্তানের জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল, যিনি বনস্পতি হয়ে ছায়া দেন সারাজীবন। বাবা মানেই তাই বনস্পতির ছায়া।

বছর ঘুরে আজ রোববার আবারও এলো বাবা দিবস। প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার পৃথিবীজুড়ে পালন করা হয় 'বিশ্ব বাবা দিবস'। এ বছর তৃতীয় রোববার হিসেবে আজ ২১ জুন পালিত হচ্ছে দিবসটি। বিশ্বজুড়ে সন্তানরা আজ পিতার প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রকাশের জন্য বিশেষভাবে পালন করবে দিবসটি। অন্তরঙ্গ সময় কাটাবে জন্মদাতার সঙ্গে, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাবে বিশেষভাবে। যাদের বাবা বেঁচে নেই, তারা হয়তো আকাশে তাকিয়ে অলক্ষ্যে বাবার স্মৃতি হাতড়াবে।

এ বছর দুনিয়াজুড়ে মহামারি আকারে জুড়ে বসেছে কভিড-১৯। এ ভাইরাসের কারণে অনেক সন্তান হারিয়েছেন প্রিয় জন্মদাতাকে। আর বেঁচে থাকা বাবারা আপ্রাণ লড়ছেন নিজ সন্তান ও পরিবারকে এর কবল থেকে রক্ষা করতে। আকালের এই কালে এবারের বাবা দিবস তাই পালিত হবে ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে। বাবাকে ঘরোয়াভাবে শুভেচ্ছার ডালিতে সিক্ত করবেন সন্তানরা।

এবারের বাবা দিবসের আগের দিন করোনা আক্রান্ত প্রখ্যাত সংস্কৃতিজন ও সাংবাদিক কামাল লোহানীকে হারিয়েছেন তার সন্তান বন্যা, উর্মি ও সাগর লোহানী। বাবা দিবস তাদের জীবনে এসেছে তীব্র বেদনার উপলব্ধি নিয়ে। বাবা দিবসের মাত্র কয়েকদিন আগে প্রিয় জনককে হারিয়েছেন সিরাজগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য প্রকৌশলী তানভীর শাকিল জয়। তার বাবা আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সংসদে সিরাজগঞ্জের মানুষের হয়ে চারবার প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

গণমানুষের সুখ ও শান্তির জন্য নিবেদিত বাবা মোহাম্মদ নাসিমকে অকস্মাৎ হারিয়ে শোকে ভারাক্রান্ত তানভীর শাকিল সমকালকে বলেন, 'প্রতিটি সন্তানের জীবনেই বাবা গুরুত্বপূর্ণ। বাবার ছায়া আর আদর্শকে ধারণ করেই সন্তানরা বেড়ে ওঠে। আমার বাবা আজীবন মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও তার কন্যা শেখ হাসিনার আদর্শের সৈনিক হিসেবে কাজ করেছেন। তাকে হারিয়ে এই বাবা দিবসে আমি শোকে মুহ্যমান। বাবার আদর্শকে লালন করে দেশবাসীর জন্য যদি কিছু করতে পারি, তাহলে হয়তো সন্তান হিসেবে তার ঋণ কিছুটা শোধ হবে।'

খ্যাতনামা লেখক, অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের কন্যা মৌলি আজাদের মনও ভারাক্রান্ত থাকে এই দিনে। সবাই নিজের বাবাকে ছুঁয়ে দেখতে পারে, তিনি তো পারেন না। মৌলি বলেন, 'সত্যিই এত বেশি খারাপ লাগে! আজকের দিনে ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে সবাই বাবাকে নিয়ে কত শত পোস্ট দেয়, ছবি দেয়। আমার খুব খারাপ লাগে। পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে। বাবা জীবিত থাকতে এই দিবসের খুব একটা চল ছিল না। আমিও শিক্ষার্থী ছিলাম, নিজের টাকা-পয়সা ছিল না। বাবাকে এ দিবসে কখনও একটা কার্ডও দেওয়া হয়নি। আজ আমার সামর্থ্য আছে, কিন্তু বাবা তো আর নেই!'

১৯১০ সালের ১৯ জুন থেকে বাবা দিবস পালনের শুরু। ১৯১৩ সালে আমেরিকান সংসদে বাবা দিবসকে ছুটির দিন ঘোষণা করার জন্য একটা বিল উত্থাপন করা হয়। ১৯২৪ সালে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলিজ বিলটিতে পূর্ণ সমর্থন দেন। অবশেষে ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন বাবা দিবসকে ছুটির দিন ঘোষণা করেন। বাবা দিবসকে ঘিরে নাটক, টকশোসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে রেডিও ও টিভি চ্যানেলগুলো।

প্রতিটি দিনই ভালোবাসার, স্নেহময়তার,- তার পরও বিশেষ এই দিনটিতে বাবাকে বিশেষভাবে স্মরণ করবে আজ সব সন্তান। বলবে, 'বাবা, তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই, এই পৃথিবীর আলোছায়ায় দুলে ওঠা, আকাশকে ছুঁতে চাওয়া, বুকের ভেতর নিশ্চিন্তে ঘুমানো আর পথে পথে চলতে শেখা- সব তোমার জন্যই সম্ভব হয়েছে, বাবা।' আর যাদের বাবা বেঁচে নেই, তারা কিছুক্ষণের জন্যে হলেও গিয়ে দাঁড়াবে তার সমাধির পাশে। বাবা অনন্তলোক থেকে সন্তানের ডাক ঠিকই শুনতে পাবেন।