রেড জোনে লকডাউন বাস্তবায়নের পরিকল্পনা থেকে সরে আসছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তার পরিবর্তে বেশ কিছু কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের চিন্তা চলছে। কারণ কর্তৃপক্ষ মনে করছে, ঢাকা শহরে যেভাবে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে জোনভিত্তিক লকডাউনের পরিবর্তে পুরো ঢাকাকেই লকডাউন করা প্রয়োজন। এ পরিস্থিতিতে জোনভিত্তিক লকডাউন করলে সাধারণ জনগণ একদিকে আর্থিক সংকটে পড়বে, অন্যদিকে তাদের ভোগান্তিও বাড়বে। তাই রেড জোন এলাকায় লকডাউন কার্যকরের জন্য ম্যাপিং কাজ চলমান থাকলেও সরকারের সংশ্নিষ্ট দপ্তর নতুন করে ভাবছে।
প্রসঙ্গত, গত ১৩ জুন রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৪৫টি এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গঠিত কেন্দ্রীয় কারিগরি কমিটি। এসব এলাকায় ক্লাস্টারভিত্তিক লকডাউন করে পূর্ব রাজাবাজার মডেলে রাজধানীতে করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আনার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু ঘোষণার ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও লকডাউন বাস্তবায়নের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বাস্তবায়নকারী অন্যতম কর্তৃপক্ষ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকেও পারেনি রেড জোনের নকশা সুনির্দিষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে। ফলে জোনভিত্তিক লকডাউন বাস্তবায়ন শুরুই হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে করোনা প্রতিরোধে গঠিত কেন্দ্রীয় কারিগরি কমিটির এক সদস্য সমকালকে বলেন, রেড জোন এলাকার ম্যাপিং কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। জোনভিত্তিক লকডাউনের অর্থ সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া- যেমন করা হয়েছে পূর্ব রাজাবাজারে। পূর্ব রাজাবাজারের মতো হয়তো সবকিছু বন্ধ না করে রেড জোন এলাকায় কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে, যা কঠোরভাবে পালন করার বিষয়টি জোরদার করা হবে। এসব বিষয়ে উচ্চপর্যায়ে আলোচনা চলছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, যে হারে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে তাতে শুধু রেড জোনে নয়, পুরো ঢাকায় একসঙ্গে কঠোর লকডাউন করতে হবে। এ ব্যাপারে সুপারিশও দেওয়া হয়েছে সরকারকে। লকডাউন দিয়ে ঢাকাকে একবারে ক্লিন করে পরে ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। চেক করে প্রবেশ করাতে হবে মানুষকে। তাহলে ঢাকায় করোনা সংক্রমণ কমবে।
নজরুল ইসলাম বলেন, রেড জোন এলাকার করোনা রোগীকে দ্রুত আইসোলেট করা দরকার। আক্রান্তদের সংস্পর্শে যারা এসেছিলেন, তাদেরও কোয়ারেন্টাইন দরকার। কিন্তু কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেই। মানুষকেও খুব বেশি সতর্ক হতে হবে। সাধারণ মানুষ মাস্ক পরছে না। মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণ আরও বাড়বে।
রাজধানীর রেড জোন নিয়ে চলছে নানা কাহিনি। প্রথম দফায় বলা হয়েছিল প্রতি লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত এলাকায় ৩০ জন সংক্রমিত হলে সেই এলাকা রেড জোনের আওতায় পড়বে। পরবর্তী ধাপে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বলা হয়, ২০১১ সালের আদমশুমারির পর প্রতি এলাকাতে জনসংখ্যা বেড়েছে। এ কারণে প্রতি লাখে ৬০ জন সংক্রমিত হলে সে এলাকাকে রেড জোন হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হবে। আবার ঢালাওভাবে ৪৫টি রেড জোন ঘোষণার পর সুনির্দিষ্টভাবে সীমানা চিহ্নিত না করায় জোনভিত্তিক লকডাউন নিয়ে শুরু হয় অনিশ্চয়তা। রেড জোনগুলোতে অধিদপ্তর এখনও বিন্দুমাত্র কোনো তদারকি কিংবা বিধিনিষেধ আরোপ করেনি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই চলছে রেড জোনের কার্যক্রম। রেড, ইয়েলো ও গ্রিন জোন সব একাকার হয়ে সংক্রমণের হারও সর্বত্রই বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সরকার এখন মনে করছে, পূর্ব রাজাবাজারের মতো ছোট একটি এলাকায় লকডাউন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলেও রাজধানীর ৪৫টি এলাকায় একসঙ্গে লকডাউন বাস্তবায়ন করা কঠিন। এমনকি রাজাবাজারেও গণমাধ্যম, চিকিৎসক, নার্স ও সেবা প্রতিষ্ঠানের লোকজনের যাতায়াত অবাধ রাখা হয়েছে। ফলে লকডাউনে শতভাগ সাফল্য আসবে না।
আবার নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় ধাপে ধাপে লকডাউন করেও শতভাগ সুফল মিলবে না। কারণ পূর্ব রাজাবাজার থেকে ২১ দিন পর লকডাউন উঠে গেলে ওই এলাকার লোক বাইরে ছড়িয়ে পড়বে। অন্য এলাকার মানুষও রাজাবাজারে প্রবেশ করবে। তখন আবারও সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে।
কাজেই কর্তৃপক্ষ মনে করছে, মফস্বল এলাকায় জোনভিত্তিক লকডাউন বাস্তবায়ন করা গেলেও রাজধানী ঢাকাতে বাস্তবায়ন করা বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য রেড জোন এলাকায় লকডাউনের পরিবর্তে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে, যা কঠোরভাবে মানাতে বাধ্য করা হবে ওই এলাকার বাসিন্দাদের। তাহলেই করোনা নিয়ন্ত্রণে আসবে।
র্বিধিনিষেধের মধ্যে থাকবে- মুদি দোকান, রেস্টুরেন্ট, কাঁচাবাজার, চা দোকান, সেলুন, শপিংমলগুলোকে শক্ত পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা। ওইসব জায়গায় শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করা। ব্যক্তিগত গাড়ি ও রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেল চলাচলও নিয়ন্ত্রণ করা হবে। পুরো বিষয় মনিটর করার জন্য স্বল্প দূরত্বে থাকবে চেকপোস্ট ও কন্ট্রোল রুম। এজন্য পুরো পরিকল্পনা করা হবে, যাতে সবার সামাজিক দূরত্বও নিশ্চিত হয়। প্রয়োজনে রাস্তাগুলোকে ওয়ান ওয়ে করে দেওয়া হবে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের রোগতত্ত্ববিদ কিংকর ঘোষ বলেন, ইতোমধ্যে জোনভিত্তিক লকডাউন নিয়ে সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযোগ আনা হয়েছে, তাকে নাকি পাওয়াই যায় না। যদি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সহযোগিতা না করে তাহলে সেই লকডাউন বৃথা। আর ঢাকা শহরের জোনভিত্তিক লকডাউন করার উদ্যোগ থেকেও সবাই সরে আসতে চাইছেন। তারা মনে করছেন, ঢাকা শহরে জোনভিত্তিক লকডাউন দেওয়ার সময় শেষ হয়ে গেছে। এখন হয়তো পুরো ঢাকা শহরে লকডাউন দিতে হবে। না হলে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণসহ কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। তবে ঢাকার বাইরে লকডাউন করা হচ্ছে।