- বাংলাদেশ
- মজুদে দাম বেড়েছে তিন থেকে চার গুণ
করোনায় ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী
মজুদে দাম বেড়েছে তিন থেকে চার গুণ

করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় ডক্সিসাইক্লিন নামের একটি ওষুধের কার্যকারিতার তথ্য দেশি-বিদেশি চিকিৎসকের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে প্রচারের পর থেকেই মানুষ ওই ওষুধের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন। ব্যাপক চাহিদার কারণে ২২০ টাকা মূল্যের এক বক্স ওষুধের দাম বেড়ে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় পৌঁছায়। বর্তমানে এই ওষুধটির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বেশিরভাগ ফার্মেসিতে ডক্সিসাইক্লিন গ্রুপের ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ আবিস্কার হয়নি। এমনকি টিকাও নেই। তবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে এর কার্যকারিতা জানার চেষ্টা বিশ্বজুড়ে অব্যাহত আছে। কয়েকটি দেশে ভ্যাকসিন নিয়েও গবেষণা চলছে। করোনা চিকিৎসায় কোনো ওষুধের কিছুটা কার্যকারিতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটির নাম ছড়িয়ে পড়ে দেশে দেশে। আর মানুষ হন্যে হয়ে ওই ওষুধের পেছনে ছুটছে। গত জানুয়ারি থেকেই এ অবস্থা চলছে।
শুরুতে চিকিৎসা সুরক্ষা সামগ্রীর ওপর চাপ তৈরি হয়েছিল। আর গত মে মাস থেকে নির্দিষ্ট কয়েকটি ওষুধের পাশাপাশি পালস অক্সিমিটার, নেবুলাইজার, অক্সিজেন সিলিন্ডার, ইনহেলারের বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে। প্রয়োজন ছাড়াই মানুষ ঘরে ঘরে এসব ওষুধ মজুদ করছেন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে একটি সিন্ডিকেট এসব ওষুধ ও সামগ্রী নিয়ে বেপরোয়া বাণিজ্যে নেমেছে। বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ৩ থেকে চার গুণ বাড়তি দামে এসব ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে। আবার কোনো কোনো ওষুধ আরও বেশি দামে বিক্রি করছে চক্রটি। অপ্রয়োজনে ওষুধ ক্রয়ের প্রতিযোগিতা দাম বৃদ্ধির প্রধান কারণ বলে মনে করেন অনেক ওষুধ ব্যবসায়ী। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, নিজের ইচ্ছামতো ওষুধ সেবনে উল্টো বিপদ ডেকে আনতে পারে। সুতরাং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের ওষুধ সেবন কাম্য নয়।
ওষুধের দোকান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সাবেক পরিচালক জাকির হোসেন রনি সমকালকে বলেন, করোনা সংক্রমণের পর ঠান্ডা, হাঁপানি, সাইনোসাইটিস ও অ্যালার্জি এবং শরীরে নানা ধরনের 'প্যারাসাইট' আক্রমণ প্রতিহত করে- এমন ওষুধের চাহিদা বেড়েছে। একই সঙ্গে ব্যাকটেরিয়াজনিত প্রদাহ প্রতিরোধে ব্যবহূত অ্যান্টিবায়োটিকের পাশাপাশি প্যারাসিটামল, ভিটামিন-সি, জিঙ্কের ঘাটতি পূরণ ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষ০মতা বাড়াতে সাহায্য করে- এমন সম্পূরক ওষুধের চাহিদাও বেড়েছে অনেক গুণ।
এ ছাড়া ক্লান্তি, মাংসপেশিতে ব্যথা, গলা ও মাথাব্যথা ইত্যাদির ওষুধ কিনতে মানুষ ওষুধের দোকানে ভিড় করছেন। করোনার প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলে করোনা আক্রান্ত রোগীদের যেসব ওষুধ সেবনের পরামর্শ চিকিৎসকরা দিয়েছেন, মানুষ মূলত সেসব ওষুধ ক্রয় করছেন। এতে বাজারে এসব ওষুধের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এ সুযোগে কেউ কেউ মূল্যও বাড়িয়ে দিয়েছে।
যেভাবে বাড়ছে ওষুধের মূল্য :রাজধানীর মিটফোর্ড ওষুধের বাজারের অন্তত পাঁচ ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনা প্রতিরোধে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন অধিক কার্যকর ফল দিচ্ছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণার পর বিশ্বজুড়ে এই ওষুধের চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। বাংলাদেশে এই ওষুধটি খোলা বাজারে বিক্রি হয় না। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রের মাধ্যমে কিছু নির্দিষ্ট স্থানে রিকোনিল নামের এই ওষুধটি পাওয়া যেত। কিন্তু ট্রাম্পের ঘোষণার পর একটি অসাধু সিন্ডিকেট মিটফোর্ডের বাজারে ওই ওষুধ ছেড়ে দেয়। ১০ পিসের একপাতা ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ছিল ১২০ টাকা। কিন্তু কালোবাজারি চক্র সেই ওষুধ ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছে।
এভাবে এজিথ্রোমাইসিন গ্রুপের জিমেক্স নামে একটি ওষুধের চাহিদাও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। প্রতি পিস ৩৫ টাকা দামের ওষুধ বিক্রি হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত। ফেক্সোফেনাডিল গ্রুপের প্রতি বক্স ১০০ টাকার ওষুধের দাম হয়েছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।
সম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ডেক্সামেথাসনের সফল ব্যবহারের খবর প্রকাশ হয়। এরপর মুহূর্তেই বিপুলসংখ্যক মানুষ কোনো ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই ওষুধটি ক্রয় করে মজুদ করতে শুরু করেন। ওষুধটির চাহিদা হঠাৎ এতটাই বেড়ে যায় যে, ঢাকার অনেক ফার্মেসি মূল কোম্পানির কাছে ওষুধটি অর্ডার করেও পাচ্ছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মিটফোর্ডের এক ওষুধ ব্যবসায়ী জানান, গত মে মাসে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মিটফোর্ডের বাজারে আইভারমেকটিন গ্রুপের স্ক্যাবো-৬ নামে একটি ওষুধের ৩ হাজার ৪০০ বক্সের চাহিদার কথা জানান। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের করোনা আক্রান্ত সদস্যদের ওই ওষুধ খাওয়ানো হবে। কিন্তু মিটফোর্ডে ওই ওষুধটি পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরাসরি প্রস্তুতকারক ওষুধ কোম্পানি থেকে পুলিশ সদস্যদের ওই ওষুধটি সরবরাহ করা হয়। এটি বাজারে ছড়িয়ে পড়ার পর ওই ওষুধটির চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। ১০ পিসের এক পাতার ১০০ টাকা মূল্যের ওষুধের দাম বেড়ে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় পৌঁছায়।
রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন সি, জিঙ্ক এবং ক্যালসিয়াম ডি নামে তিনটি ওষুধের নাম আলোচনায় আসে কয়েকদিন আগে। মিটফোর্ডের একটি ওষুধের দোকান মালিক নিখিল চন্দ্র জানান, আগে এক বক্স ভিটামিন সি বিক্রি হতো ৪৭২ টাকায়। এখন তা ৮০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। ১০ পিসের আয়রন জাতীয় এক পাতা জিঙ্ক ট্যাবলেট বিক্রি হতো ৩০ টাকা। এখন তা বেড়ে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা হয়েছে। প্রতি পিসের ২০০ আই ইউর ক্যালসিয়াম ডি আগে বিক্রি হতো ৮ টাকা করে। এখন তা বেড়ে ১২ থেকে ১৩ টাকা হয়েছে। জমাট বাঁধা রক্ত তরল ওরাডেক্সন গ্রুপের ইনজেকশন অধিক কার্যকর। প্রতি পিস ৩০ টাকা মূল্যে এই ইনজেকশনের দাম বেড়ে ৫০ থেকে ৬০ টাকা হয়েছে। বর্তমানে ওষুধের দোকানগুলোতেও এসব ওষুধের সংকট চলছে।
লাজ ফার্মার ম্যানেজার আনোয়ার হোসেন সমকালকে বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে স্কাভো-৬, ইভেরা-১২, প্যারাসিটামল, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, অ্যান্টিহিস্টাসিন, অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ও ভিটামিন সি ট্যাবলেট জাতীয় ওষুধের বিক্রি কয়েকগুণ বেড়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় সংকট তৈরি হয়েছে। আর এই সংকটের কারণে দামও বেড়েছে।
সুরক্ষা সামগ্রী নিয়েও সিন্ডিকেট :করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকতে মাস্ক, ফেসশিট, গ্লাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, পিপিইসহ বিভিন্ন সুরক্ষা সামগ্রীর চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। বর্তমানে তা কিছুটা কমলেও এখনও বাড়তি দামে এসব পণ্যসামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর তোপখানা রোডের বিএমএ ভবন ও এর আশপাশে মেডিকেল সুরক্ষা সামগ্রী বিক্রি করা হয়।
এখানকার কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, দেশে করোনা সংক্রমণের পর প্রথম মাস্কের দাম বাড়ে। এক পিস ৩০ টাকার মাস্ক ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। পরে ঔষধ প্রশাসন মাস্কের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৩০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। এরপর বাজারে মাস্কের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়। এখনও বাজারে ৩০ টাকা মূল্যের মাস্ক ৫০ থেকে ৮০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। হ্যান্ড স্যানিটাইজারেরও মারাত্মক সংকট তৈরি হয়েছিল। ১০০ এমএল হ্যান্ড স্যানিটাইজার ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। ৫০ জোড়া এক বক্স ১৮০ টাকা দামের গ্লাভস বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা দামে। ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মূল্যের পিপিই সেট ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে।
পালস অক্সিমিটার ও অক্সিজেন সিলিন্ডারের চাহিদা তুঙ্গে :বর্তমানে পাসল অক্সিমিটার ও অক্সিজেন সিলিন্ডারের রমরমা বাণিজ্য চলছে। করোনা আক্রান্ত মানুষের হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসার সুযোগ কমে আছে। প্রতিদিন যে পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের ভর্তি করার সক্ষমতা স্বাস্থ্য বিভাগের নেই। এ কারণে শ্বাসকষ্টের রোগীদের বাসায় রেখে সুরক্ষার জন্য এসব পণ্যের দাম বেড়েছে।
করোনা আক্রান্ত রোগীদের অক্সিজেন সংকট দেখা দেয়। অক্সিজেনের মাত্রা পরিমাপের জন্য অনেকেই বাসাবাড়িতে পালস অক্সিমিটার কিনে রাখছেন। এতে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা মূল্যে পালস অক্সিমিটারের দাম বেড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা হয়েছে। একইভাবে অনেকে বাসাবাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে রাখছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অক্সিজেন সিলিন্ডার বাসায় সরবরাহের বিজ্ঞাপনও প্রচার করা হচ্ছে। একই সঙ্গে মোবাইল ফোনেও অক্সিজেন সিলিন্ডার, পালস অক্সিমিটারসহ অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহের খুদেবার্তা পাঠানো হচ্ছে। এ প্রতিবেদকের মোবাইল ফোনেও এমন একটি খুদেবার্তা এসেছে। সেখানে পালস অক্সিমিটারের মূল্য দুই হাজার ৯০০ টাকা, ল্যাটেক্স গ্লাভস এক হাজার ৪০০ টাকা, পিপিই এক হাজার ৫০০ টাকা, কেএন ৯৫ মাস্ক ১৭৯ টাকা, এন-৯৫ মাস্ক ইউএসএ এক হাজার ১৯০ টাকা, গগলস ১৯৯ টাকা এবং অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ৮৫ হাজার টাকা মূল্য চাওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতি আস্থাহীনতার কারণেই মানুষ নিজ উদ্যোগে এসব সামগ্রী সংগ্রহ করছেন। আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার যথাযথ ব্যবস্থা থাকলে মানুষ বাসাবাড়িতে পালস অক্সিমিটার ও অক্সিজেন সিলিন্ডারের মতো সামগ্রী মজুদ করত না। সুযোগ কাজে লাগিয়ে অসাধু সিন্ডিকেট বাণিজ্য করবে- এমনটি স্বাভাবিক। এজন্য সরকারি উদ্যোগে হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। পর্যাপ্ত অক্সিজেনসহ অন্যান্য সামগ্রীর ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে এসব নিয়ে বাণিজ্য বন্ধ হবে।
চিকিৎসকদের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন ঝুঁকিপূর্ণ- মত বিশেষজ্ঞদের :বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া যে কোনো ওষুধ ব্যবহার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে মত দিয়েছেন প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ। তিনি সমকালকে বলেন, প্রতিটি ওষুধেরই কোনো না কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। একেকজনের শরীরে একের ধরনের প্রভাব পড়ে। চিকিৎসকরা রোগীর কাছে প্রশ্ন করে বিস্তারিত জেনে ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন। কিন্তু রোগী না জেনেবুঝে ওষুধ সেবন করলে সুস্থতার পরিবর্তে উল্টো বিপদ বাড়তে পারে। ডা. আব্দুল্লাহ বলেন, রোগ প্রতিরোধে অনেকে আগেভাগে ওষুধ সেবন করছেন। এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, প্রত্যেক মানুষের শরীরে কিছু অর্গানিজম থাকে। প্রয়োজন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে ফেললে তখন সেই অর্গানিজম অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে নির্দিষ্ট সেই অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারায়। এভাবে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী শরীরে প্রয়োজনের সময় ব্যবহূত অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করবে না। একইভাবে কিছু স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধও মানুষ ব্যবহার করছে। এতে কিডনি ও ডায়াবেটিস জাতীয় সমস্যা থাকা ব্যক্তিরা মারাত্মক বিপদে পড়তে পারেন। সুতরাং চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ সেবনের ফল ভালো হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. আ ব ম ফারুক সমকালকে বলেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিভিন্ন ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে জনশ্রুতি আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে এই রোগ প্রতিরোধের কোনো ওষুধ পাওয়া যায়নি। যখন যে ওষুধের নাম শোনা যাচ্ছে মানুষ সেই ওষুধের পেছনে ছুটছেন। নিজ উদ্যোগে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে বাসাবাড়িতে রাখছেন। এভাবে বিভিন্ন ধরনের ওষুধের নাম আসার কারণে কোনটা রেখে কোনটা সেবন করবেন, তা নিয়ে বিভ্রান্তি বাড়ছে। একসঙ্গে সব ওষুধ কেউ সেবন করলে তখন তা বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। আবার মাসের পর মাস ঘরে মজুদ থাকা এবং সঠিক তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা না থাকার কারণে ওষুধের কার্যকারিতা হারাতে পারে। ওই ওষুধ সেবনে ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন করা থেকে বিরত থাকার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানাই। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবনে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। আবার বাড়তি ওষুধ কিনে মজুদ করে রাখার কারণে প্রয়োজন আছে এমন রোগীও হয়তো সময়মতো ওষুধটি পাবেন না। এতে ওই ব্যক্তির জীবন রক্ষা করাও কঠিন হয়ে পড়তে পারে। সুতরাং এসব বিষয় বিবেচনা করতে হবে।
তিনি বলেন, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে ইতোমধ্যে বাজার মনিটরিংয়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত মূল্যের তুলনায় বাড়তি মূল্যে ওষুধ ও সুরক্ষা সামগ্রী কেউ বিক্রি করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে কয়েকজনকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ আবিস্কার হয়নি। এমনকি টিকাও নেই। তবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে এর কার্যকারিতা জানার চেষ্টা বিশ্বজুড়ে অব্যাহত আছে। কয়েকটি দেশে ভ্যাকসিন নিয়েও গবেষণা চলছে। করোনা চিকিৎসায় কোনো ওষুধের কিছুটা কার্যকারিতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটির নাম ছড়িয়ে পড়ে দেশে দেশে। আর মানুষ হন্যে হয়ে ওই ওষুধের পেছনে ছুটছে। গত জানুয়ারি থেকেই এ অবস্থা চলছে।
শুরুতে চিকিৎসা সুরক্ষা সামগ্রীর ওপর চাপ তৈরি হয়েছিল। আর গত মে মাস থেকে নির্দিষ্ট কয়েকটি ওষুধের পাশাপাশি পালস অক্সিমিটার, নেবুলাইজার, অক্সিজেন সিলিন্ডার, ইনহেলারের বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে। প্রয়োজন ছাড়াই মানুষ ঘরে ঘরে এসব ওষুধ মজুদ করছেন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে একটি সিন্ডিকেট এসব ওষুধ ও সামগ্রী নিয়ে বেপরোয়া বাণিজ্যে নেমেছে। বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ৩ থেকে চার গুণ বাড়তি দামে এসব ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে। আবার কোনো কোনো ওষুধ আরও বেশি দামে বিক্রি করছে চক্রটি। অপ্রয়োজনে ওষুধ ক্রয়ের প্রতিযোগিতা দাম বৃদ্ধির প্রধান কারণ বলে মনে করেন অনেক ওষুধ ব্যবসায়ী। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, নিজের ইচ্ছামতো ওষুধ সেবনে উল্টো বিপদ ডেকে আনতে পারে। সুতরাং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের ওষুধ সেবন কাম্য নয়।
ওষুধের দোকান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সাবেক পরিচালক জাকির হোসেন রনি সমকালকে বলেন, করোনা সংক্রমণের পর ঠান্ডা, হাঁপানি, সাইনোসাইটিস ও অ্যালার্জি এবং শরীরে নানা ধরনের 'প্যারাসাইট' আক্রমণ প্রতিহত করে- এমন ওষুধের চাহিদা বেড়েছে। একই সঙ্গে ব্যাকটেরিয়াজনিত প্রদাহ প্রতিরোধে ব্যবহূত অ্যান্টিবায়োটিকের পাশাপাশি প্যারাসিটামল, ভিটামিন-সি, জিঙ্কের ঘাটতি পূরণ ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষ০মতা বাড়াতে সাহায্য করে- এমন সম্পূরক ওষুধের চাহিদাও বেড়েছে অনেক গুণ।
এ ছাড়া ক্লান্তি, মাংসপেশিতে ব্যথা, গলা ও মাথাব্যথা ইত্যাদির ওষুধ কিনতে মানুষ ওষুধের দোকানে ভিড় করছেন। করোনার প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলে করোনা আক্রান্ত রোগীদের যেসব ওষুধ সেবনের পরামর্শ চিকিৎসকরা দিয়েছেন, মানুষ মূলত সেসব ওষুধ ক্রয় করছেন। এতে বাজারে এসব ওষুধের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এ সুযোগে কেউ কেউ মূল্যও বাড়িয়ে দিয়েছে।
যেভাবে বাড়ছে ওষুধের মূল্য :রাজধানীর মিটফোর্ড ওষুধের বাজারের অন্তত পাঁচ ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনা প্রতিরোধে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন অধিক কার্যকর ফল দিচ্ছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণার পর বিশ্বজুড়ে এই ওষুধের চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। বাংলাদেশে এই ওষুধটি খোলা বাজারে বিক্রি হয় না। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রের মাধ্যমে কিছু নির্দিষ্ট স্থানে রিকোনিল নামের এই ওষুধটি পাওয়া যেত। কিন্তু ট্রাম্পের ঘোষণার পর একটি অসাধু সিন্ডিকেট মিটফোর্ডের বাজারে ওই ওষুধ ছেড়ে দেয়। ১০ পিসের একপাতা ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ছিল ১২০ টাকা। কিন্তু কালোবাজারি চক্র সেই ওষুধ ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছে।
এভাবে এজিথ্রোমাইসিন গ্রুপের জিমেক্স নামে একটি ওষুধের চাহিদাও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। প্রতি পিস ৩৫ টাকা দামের ওষুধ বিক্রি হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত। ফেক্সোফেনাডিল গ্রুপের প্রতি বক্স ১০০ টাকার ওষুধের দাম হয়েছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।
সম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ডেক্সামেথাসনের সফল ব্যবহারের খবর প্রকাশ হয়। এরপর মুহূর্তেই বিপুলসংখ্যক মানুষ কোনো ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই ওষুধটি ক্রয় করে মজুদ করতে শুরু করেন। ওষুধটির চাহিদা হঠাৎ এতটাই বেড়ে যায় যে, ঢাকার অনেক ফার্মেসি মূল কোম্পানির কাছে ওষুধটি অর্ডার করেও পাচ্ছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মিটফোর্ডের এক ওষুধ ব্যবসায়ী জানান, গত মে মাসে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মিটফোর্ডের বাজারে আইভারমেকটিন গ্রুপের স্ক্যাবো-৬ নামে একটি ওষুধের ৩ হাজার ৪০০ বক্সের চাহিদার কথা জানান। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের করোনা আক্রান্ত সদস্যদের ওই ওষুধ খাওয়ানো হবে। কিন্তু মিটফোর্ডে ওই ওষুধটি পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরাসরি প্রস্তুতকারক ওষুধ কোম্পানি থেকে পুলিশ সদস্যদের ওই ওষুধটি সরবরাহ করা হয়। এটি বাজারে ছড়িয়ে পড়ার পর ওই ওষুধটির চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। ১০ পিসের এক পাতার ১০০ টাকা মূল্যের ওষুধের দাম বেড়ে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় পৌঁছায়।
রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন সি, জিঙ্ক এবং ক্যালসিয়াম ডি নামে তিনটি ওষুধের নাম আলোচনায় আসে কয়েকদিন আগে। মিটফোর্ডের একটি ওষুধের দোকান মালিক নিখিল চন্দ্র জানান, আগে এক বক্স ভিটামিন সি বিক্রি হতো ৪৭২ টাকায়। এখন তা ৮০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। ১০ পিসের আয়রন জাতীয় এক পাতা জিঙ্ক ট্যাবলেট বিক্রি হতো ৩০ টাকা। এখন তা বেড়ে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা হয়েছে। প্রতি পিসের ২০০ আই ইউর ক্যালসিয়াম ডি আগে বিক্রি হতো ৮ টাকা করে। এখন তা বেড়ে ১২ থেকে ১৩ টাকা হয়েছে। জমাট বাঁধা রক্ত তরল ওরাডেক্সন গ্রুপের ইনজেকশন অধিক কার্যকর। প্রতি পিস ৩০ টাকা মূল্যে এই ইনজেকশনের দাম বেড়ে ৫০ থেকে ৬০ টাকা হয়েছে। বর্তমানে ওষুধের দোকানগুলোতেও এসব ওষুধের সংকট চলছে।
লাজ ফার্মার ম্যানেজার আনোয়ার হোসেন সমকালকে বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে স্কাভো-৬, ইভেরা-১২, প্যারাসিটামল, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, অ্যান্টিহিস্টাসিন, অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ও ভিটামিন সি ট্যাবলেট জাতীয় ওষুধের বিক্রি কয়েকগুণ বেড়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় সংকট তৈরি হয়েছে। আর এই সংকটের কারণে দামও বেড়েছে।
সুরক্ষা সামগ্রী নিয়েও সিন্ডিকেট :করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকতে মাস্ক, ফেসশিট, গ্লাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, পিপিইসহ বিভিন্ন সুরক্ষা সামগ্রীর চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। বর্তমানে তা কিছুটা কমলেও এখনও বাড়তি দামে এসব পণ্যসামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর তোপখানা রোডের বিএমএ ভবন ও এর আশপাশে মেডিকেল সুরক্ষা সামগ্রী বিক্রি করা হয়।
এখানকার কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, দেশে করোনা সংক্রমণের পর প্রথম মাস্কের দাম বাড়ে। এক পিস ৩০ টাকার মাস্ক ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। পরে ঔষধ প্রশাসন মাস্কের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৩০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। এরপর বাজারে মাস্কের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়। এখনও বাজারে ৩০ টাকা মূল্যের মাস্ক ৫০ থেকে ৮০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। হ্যান্ড স্যানিটাইজারেরও মারাত্মক সংকট তৈরি হয়েছিল। ১০০ এমএল হ্যান্ড স্যানিটাইজার ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। ৫০ জোড়া এক বক্স ১৮০ টাকা দামের গ্লাভস বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা দামে। ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মূল্যের পিপিই সেট ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে।
পালস অক্সিমিটার ও অক্সিজেন সিলিন্ডারের চাহিদা তুঙ্গে :বর্তমানে পাসল অক্সিমিটার ও অক্সিজেন সিলিন্ডারের রমরমা বাণিজ্য চলছে। করোনা আক্রান্ত মানুষের হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসার সুযোগ কমে আছে। প্রতিদিন যে পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের ভর্তি করার সক্ষমতা স্বাস্থ্য বিভাগের নেই। এ কারণে শ্বাসকষ্টের রোগীদের বাসায় রেখে সুরক্ষার জন্য এসব পণ্যের দাম বেড়েছে।
করোনা আক্রান্ত রোগীদের অক্সিজেন সংকট দেখা দেয়। অক্সিজেনের মাত্রা পরিমাপের জন্য অনেকেই বাসাবাড়িতে পালস অক্সিমিটার কিনে রাখছেন। এতে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা মূল্যে পালস অক্সিমিটারের দাম বেড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা হয়েছে। একইভাবে অনেকে বাসাবাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে রাখছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অক্সিজেন সিলিন্ডার বাসায় সরবরাহের বিজ্ঞাপনও প্রচার করা হচ্ছে। একই সঙ্গে মোবাইল ফোনেও অক্সিজেন সিলিন্ডার, পালস অক্সিমিটারসহ অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহের খুদেবার্তা পাঠানো হচ্ছে। এ প্রতিবেদকের মোবাইল ফোনেও এমন একটি খুদেবার্তা এসেছে। সেখানে পালস অক্সিমিটারের মূল্য দুই হাজার ৯০০ টাকা, ল্যাটেক্স গ্লাভস এক হাজার ৪০০ টাকা, পিপিই এক হাজার ৫০০ টাকা, কেএন ৯৫ মাস্ক ১৭৯ টাকা, এন-৯৫ মাস্ক ইউএসএ এক হাজার ১৯০ টাকা, গগলস ১৯৯ টাকা এবং অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ৮৫ হাজার টাকা মূল্য চাওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতি আস্থাহীনতার কারণেই মানুষ নিজ উদ্যোগে এসব সামগ্রী সংগ্রহ করছেন। আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার যথাযথ ব্যবস্থা থাকলে মানুষ বাসাবাড়িতে পালস অক্সিমিটার ও অক্সিজেন সিলিন্ডারের মতো সামগ্রী মজুদ করত না। সুযোগ কাজে লাগিয়ে অসাধু সিন্ডিকেট বাণিজ্য করবে- এমনটি স্বাভাবিক। এজন্য সরকারি উদ্যোগে হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। পর্যাপ্ত অক্সিজেনসহ অন্যান্য সামগ্রীর ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে এসব নিয়ে বাণিজ্য বন্ধ হবে।
চিকিৎসকদের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন ঝুঁকিপূর্ণ- মত বিশেষজ্ঞদের :বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া যে কোনো ওষুধ ব্যবহার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে মত দিয়েছেন প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ। তিনি সমকালকে বলেন, প্রতিটি ওষুধেরই কোনো না কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। একেকজনের শরীরে একের ধরনের প্রভাব পড়ে। চিকিৎসকরা রোগীর কাছে প্রশ্ন করে বিস্তারিত জেনে ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন। কিন্তু রোগী না জেনেবুঝে ওষুধ সেবন করলে সুস্থতার পরিবর্তে উল্টো বিপদ বাড়তে পারে। ডা. আব্দুল্লাহ বলেন, রোগ প্রতিরোধে অনেকে আগেভাগে ওষুধ সেবন করছেন। এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, প্রত্যেক মানুষের শরীরে কিছু অর্গানিজম থাকে। প্রয়োজন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে ফেললে তখন সেই অর্গানিজম অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে নির্দিষ্ট সেই অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারায়। এভাবে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী শরীরে প্রয়োজনের সময় ব্যবহূত অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করবে না। একইভাবে কিছু স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধও মানুষ ব্যবহার করছে। এতে কিডনি ও ডায়াবেটিস জাতীয় সমস্যা থাকা ব্যক্তিরা মারাত্মক বিপদে পড়তে পারেন। সুতরাং চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ সেবনের ফল ভালো হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. আ ব ম ফারুক সমকালকে বলেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিভিন্ন ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে জনশ্রুতি আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে এই রোগ প্রতিরোধের কোনো ওষুধ পাওয়া যায়নি। যখন যে ওষুধের নাম শোনা যাচ্ছে মানুষ সেই ওষুধের পেছনে ছুটছেন। নিজ উদ্যোগে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে বাসাবাড়িতে রাখছেন। এভাবে বিভিন্ন ধরনের ওষুধের নাম আসার কারণে কোনটা রেখে কোনটা সেবন করবেন, তা নিয়ে বিভ্রান্তি বাড়ছে। একসঙ্গে সব ওষুধ কেউ সেবন করলে তখন তা বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। আবার মাসের পর মাস ঘরে মজুদ থাকা এবং সঠিক তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা না থাকার কারণে ওষুধের কার্যকারিতা হারাতে পারে। ওই ওষুধ সেবনে ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন করা থেকে বিরত থাকার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানাই। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবনে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। আবার বাড়তি ওষুধ কিনে মজুদ করে রাখার কারণে প্রয়োজন আছে এমন রোগীও হয়তো সময়মতো ওষুধটি পাবেন না। এতে ওই ব্যক্তির জীবন রক্ষা করাও কঠিন হয়ে পড়তে পারে। সুতরাং এসব বিষয় বিবেচনা করতে হবে।
তিনি বলেন, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে ইতোমধ্যে বাজার মনিটরিংয়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত মূল্যের তুলনায় বাড়তি মূল্যে ওষুধ ও সুরক্ষা সামগ্রী কেউ বিক্রি করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে কয়েকজনকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
মন্তব্য করুন