গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোতেও করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তের তালিকায় তিনজন সচিবও রয়েছেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের স্ত্রী তথ্য সচিব কামরুন নাহার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্ন অবস্থায়) রয়েছেন। এ অবস্থায় ব্যাহত হচ্ছে সরকারের দাপ্তরিক কাজ। জুন ক্লোজিংসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক কার্যক্রম থমকে গেছে। সংশ্নিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, কভিড-১৯ শুরুর পর থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বাসা থেকে অফিস করছেন। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মাঝেমধ্যে জরুরি কাজে মন্ত্রণালয়ে গেলেও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী সব কাজই করছেন বাসা থেকে। বদলি, পদায়ন, পদোন্নতি ও ছুটির প্রজ্ঞাপনসহ গুরুত্বপূর্ণ ফাইল স্বাক্ষর করছেন বাসায়। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস) মো. রেজাউল আলম প্রতিনিয়তই বিভিন্ন ফাইল অফিস থেকে নিয়ে যাচ্ছেন প্রতিমন্ত্রীর বাসায়। একইভাবে শীর্ষ অনেক কর্মকর্তা বাসা থেকে অফিস করছেন। এদিকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের সচিবসহ শীর্ষ অনেক কর্মকর্তা যৌক্তিক কারণে দপ্তরে অনুপস্থিত। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব করোনায় আক্রান্ত, করোনায় স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব আইসোলেশনে রয়েছেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আব্দুল্লাহ আল মোহসীনও করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন।
সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, দেশ পরিচালনায় প্রশাসনে কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে তারা নিজেরাই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস) মো. রেজাউল আলম সমকালকে বলেন, তিনি প্রতিনিয়তই অফিসের সব ফাইল প্রতিমন্ত্রীর বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন। মন্ত্রণালয়ের কোনো কাজ থেমে নেই। গত বৃহস্পতিবারও তিনি প্রতিমন্ত্রীর বাসায় গেছেন।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রায় ৫০ জন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ২৩ জন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ৪১ জন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রায় ৯০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে অফিসিয়ালি তালিকাভুক্ত আছেন শতাধিক কর্মকর্তা। বাকি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিসে করোনা আক্রান্তের তথ্য না জানিয়ে ছুটিতে আছেন। যেসব শাখায় আক্রান্ত হয়েছেন সেসব শাখার অন্য অনেক কর্মকর্তা-কমচারীও হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। গত রোববার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ২০ জন কর্মকর্তার করোনা পরীক্ষার ফলে ১৭ জনের রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। করোনা সংক্রমণ যতই বাড়ছে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের কার্যক্রম ততই ব্যাহত হচ্ছে। তবে আক্রান্তদের বেশিরভাগই বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুনের একান্ত সচিব (পিএস) শামীম আহমেদ ও সচিবের কম্পিউটার অপারেটর রাকিবুল হক ভূঁইয়া, বাসার গাড়িচালক মো. নুরুল্লাহ এবং অফিস সহায়ক অরবিন্দ, নিপুন পান্ডে ও রঞ্জু করোনায় আক্রান্ত। তারা বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। জনপ্রশাসন সচিবও আইসোলেশনে রয়েছেন। সচিবের দপ্তরে বেশিসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী আক্রান্ত হওয়ায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, অফিসে গেলেই তারা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এজন্য জনপ্রশাসনের বেশিরভাগ কর্মকর্তা ছুটিতে আছেন। ভয়ে অনেকে অফিস করছেন না। এতে মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয়ে ঘাটতি হচ্ছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সমকালকে বলেন, তিনি বাসায় আইসোলেশনে রয়েছেন। বাসা থেকে অনলাইনে অফিসের সব কাজ করছেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া সমকালকে বলেন, করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সব কর্মকর্তা নিয়মিত অফিস করছেন। মাঠ প্রশাসন ও মন্ত্রণালয়গুলোকে যথাযথভাবে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ছয়-সাতজন গাড়িচালক করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে সর্বশেষ তথ্য আমার জানা নেই।
জানা যায়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাদের সহায়তার জন্য কুইক রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে। একজন উপসচিবকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের এই টিম গঠন করা হয়েছে। কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী আক্রান্ত হলে এই টিম তার এবং তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। প্রয়োজনে আক্রান্তদের চাহিদার ভিত্তিতে খাদ্য, ওষুধ, চিকিৎসাসহ অন্যান্য বিষয়েও সার্বিক সহযোগিতা দেবে। এ ছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারবেন। তবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কুইক রেসপন্স টিমের টিম লিডার উপসচিব (সাধারণ সেবা অধিশাখা) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান নিজেও করোনায় আক্রান্ত। তিনি গত ১৭ জুন থেকে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের এক যুগ্ম সচিব সমকালকে বলেন, কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে তাদের ছুটি দেওয়া হয়। দীর্ঘ সময় তারা ছুটিতে থাকেন। অনেক সময় সংশ্নিষ্ট শাখার অন্য কর্মকর্তাদেরও হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠাতে হয়। এতে কাজে হিমশিম খাচ্ছি। অনেক কাজ জমে আছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক উপসচিব বলেন, অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী আক্রান্তের তথ্য গোপন করছেন। কারণ, আক্রান্তের কথা বেশি মানুষ জানলে অনেক সময় সামাজিকভাবে সমস্যায় পড়তে হয়। ফলে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলোতে অফিসিয়ালি আক্রান্তের যে তথ্য আছে তার চেয়ে অনেক বেশি আক্রান্ত রয়েছেন। তবে আক্রান্ত ব্যক্তিরা ছুটিতে আছেন।