- বাংলাদেশ
- আগাম প্রস্তুতি না থাকায় বিপাকে বানভাসি মানুষ
আগাম প্রস্তুতি না থাকায় বিপাকে বানভাসি মানুষ
ক্ষতি বেশি কৃষকের

উজানের ঢলে বাড়িঘর ডুবে যাওয়ায় আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন আমেনা বেগম। বৃহস্পতিবার গাইবান্ধার ফুলছড়ির উড়িয়া গ্রাম থেকে তোলা ছবি -ফোকাস বাংলা
উত্তরের সীমান্তবর্তী নদী ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ১০২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। এর প্রভাবে শুধু কুড়িগ্রামেই পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত তিন লাখ মানুষ। সরকারিভাবে অনেক আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখার কথা বলা হলেও সীমা ছাড়িয়েছে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ। গবাদিপশু নিয়ে বানভাসিরা আশ্রয় নিয়েছে বাঁধের ওপর। কেউবা ঘরের চালে। বিশুদ্ধ পানি এবং শুকনো খাবারের চরম সংকট সেখানে। একই পরিস্থিতি গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়ায়ও। উপচে উঠেছে যমুনার পানি। কোথাও বিপদসীমার ১২৫, কোথাও ১২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি উদ্যোগে বন্যাদুর্গত এলাকার জন্য বিপুল পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী মজুদ রাখা হলেও আগাম প্রস্তুতি না থাকায় সংকট মোকাবিলা কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্য দুর্যোগে আগাম প্রস্তুতি থাকলেও বন্যার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান তৎপরতা দেখা যায় না। পানি ঢুকে পড়ার পর শুরু হয় তোড়জোড়। অথচ বন্যার পূর্বাভাস আগেই দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে বন্যার ১৯ দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। তবু উপদ্রুত এলাকায় মানুষের কষ্ট লাঘব না হওয়াকে অব্যবস্থাপনার পরিণাম বলছেন তারা।
এদিকে, চলতি বন্যা দীর্ঘমেয়াদি হবে বলেই আশঙ্কা করছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। উজানে অতিবৃষ্টি অব্যাহত থাকলে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পানির নিচে থাকতে পারে উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ জনপদ। এরই মধ্যে মধ্যাঞ্চল তলিয়ে ঢাকার নিম্নাঞ্চলও প্লাবিত। কৃষি বিভাগও আশঙ্কা করছে, অন্তত জুলাই মাস এ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তবে বন্যা পরিস্থিতি আগস্ট স্পর্শ করলে সংকটে পড়তে পারে আমনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন। ইতোমধ্যে ১৫ জেলায় তরিতরকারি-শাকসবজিসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষি বিভাগের প্রাথমিক হিসাবে সাড়ে তিন লাখ কৃষকের ৩৫০ কোটি টাকার ফসলের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে।
ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে যোগাযোগ করে জানা গেছে, সরকারি উদ্যোগে ত্রাণ তৎপরতা থাকলেও খাদ্য ও চিকিৎসার চরম সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকার জন্য মেডিকেল টিম গঠন করা হলেও উপদ্রুত অনেক জেলায় এসব টিমের কার্যক্রম চালু হয়নি। অনেক জেলায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলেও লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে অনাগ্রহী। আবার অপেক্ষাকৃত বেশি উপদ্রুত এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলাই হয়নি।
বন্যা পরিস্থিতিতে জনদুর্ভোগ লাঘবে আগাম প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি জানিয়ে দুর্যোগ গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা সমকালকে বলেন, 'কেন্দ্রীয়ভাবে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগে থেকে প্রস্তুতির কোনো নজির নেই। বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেই তৎপরতা শুরু হয়। একের পর এক গ্রাম প্লাবিত হয়ে গেলে মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন সমন্বয় সাধন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এ জন্য বন্যা মৌসুমের আগেই প্রস্তুতি সেরে রাখা ভালো।'
তিনি আরও বলেন, এ মুহূর্তে বেশি দুর্গত এলাকায় উদ্ধার তৎপরতা চালানো জরুরি। কিন্তু বাস্তবে সেটি হচ্ছে না। রৌমারীতে অনেক মানুষ গবাদিপশু নিয়ে বাঁধ কিংবা ঘরের চালে আশ্রয় নিয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের উচিত বানভাসিদের দ্রুত উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা। বিভিন্ন এলাকায় বিষধর সাপের ছোবলে অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। কিন্তু অ্যান্টি-ভেনম কোথায় পাওয়া যাবে- এ বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য নেই। এগুলো এখনই নিশ্চিত করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্নেষণ করলেও পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতির চিত্র পাওয়া যায় না। এবার বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় ২৬ জুন। আগাম বন্যায় দেশের ১০ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় উপদ্রুত এলাকার জন্য প্রথম ধাপে ত্রাণসামগ্রী বরাদ্দ দেয় ৪ জুলাই। অথচ ওই সময় প্রথম ধাপের বন্যা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসে।
তথ্য বিশ্নেষণে দেখা যায়, ১১ জুলাই থেকে ব্যাপ্তি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার পূর্বাভাস পেয়েই নড়েচড়ে বসে সরকার। পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণে প্রথম বৈঠক হয় ৯ জুলাই। মাঠপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্ত মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন হতে শুরু করার আগেই জেলার পর জেলা প্লাবিত হতে থাকে। ততক্ষণে পরিস্থিতি মোকাবিলা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে।
তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন সমকালকে বলেন, বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘ হবে, এ পূর্বাভাস পেয়েই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তৃণমূল পর্যন্ত ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কথা হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘ হলেও খাদ্য ও পানীয় জলের সংকট হবে না।
জানা গেছে, এ পর্যন্ত সাত দফায় বন্যাদুর্গত এলাকার জন্য নগদ অর্থ ও ত্রাণ সামগ্রী বরাদ্দ দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে রয়েছে নগদ সহায়তার জন্য প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা, বিতরণের জন্য আট হাজার ২১০ টন চাল, আশ্রয়কেন্দ্র ও উপদ্রুত এলাকার মানুষের জন্য ৭৪ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, শিশুখাদ্য এবং গো-খাদ্যের জন্য প্রায় এক কোটি টাকা।
মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনের তথ্য মতে, উপদ্রুত এলাকায় ইতোমধ্যে চার হাজার টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। নগদ অর্থ বিতরণ হয়েছে প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকা। এ ছাড়া শিশুখাদ্য বাবদ ১৮ লাখ, গো-খাদ্যের জন্য দেওয়া হয়েছে ১৬ লাখ টাকা। প্রায় ৫০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার এবং অনেক এলাকায় ঢেউটিন বিতরণ করা হয়েছে।
দীর্ঘ হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতি : বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভুঁইয়া সমকালকে বলেন, 'বুধবার পর্যন্ত দেশের অন্তত ৩৩ শতাংশ জেলায় বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই তা ৪০ শতাংশ অতিক্রম করতে পারে। বন্যা পরিস্থিতি সহজে কাটছে না। অন্তত জুলাই মাস পুরোটা এ অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, এটি অনেকটা নিশ্চিত। তবে এ মুহূর্তে যে অবস্থা বিরাজমান, তাতে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বন্যা পরিস্থিতি থাকতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, ২৬ জুন থেকে হিসাব কষলে এ বন্যা ইতোমধ্যে ১৯ দিন পার করেছে। অবশ্য মেয়াদের দিক থেকে এটি অনেক দীর্ঘ হতে চললেও ব্যাপ্তির দিক থেকে '৯৮-এর বন্যার মতো নয়। এ ছাড়া বিস্তীর্ণ জনপদ মিশিয়ে দেওয়া বা বাঁধের পর বাঁধ গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়তো হবে না।
ফসলের ক্ষতি ৩৫০ কোটি টাকা : ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর আরেক দফা ক্ষতি হলো ফসলের। আম্পানের কারণে ৬৭১ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছিল। সেই ক্ষতি কাটিয়ে না উঠতেই কৃষকের ওপর বন্যার আঘাত। চলতি বন্যায় অন্তত সাড়ে তিন লাখ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রাথমিক হিসাবে ৩৫০ কোটি টাকার ফসলের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পেয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
সরেজমিন উইংয়ের তথ্য, ৯ জুলাই পর্যন্ত বন্যায় ১৪ জেলায় আউশ ও আমনসহ বিভিন্ন ফসলের ৪৩ হাজার হেক্টর ফসলের ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন ফসলের উৎপাদনে এই ক্ষতির পরিমাণ এক লাখ ৪১ হাজার ৯৮৬ টন। ক্ষতিগ্রস্ত অন্য ফসলগুলো হলো গ্রীষ্ফ্মকালীন সবজি, ভুট্টা, চীনাবাদাম, তিল, মরিচ, পাট, কলাবাগান ও আখ।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুল মুঈদ সমকালকে বলেন, 'বন্যায় যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়েই গেছে। নতুন করে খুব বেশি ক্ষতির আশঙ্কা নেই। আউশের কিছু ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা হলো আমন নিয়ে। এটি খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ভূমিকা রাখে। আমনের বীজতলা নিয়ে সংশয় এখনও আছে। তবে পূর্বাভাস রয়েছে ২৫-২৬ জুলাইয়ের মধ্যে চলতি বন্যা কেটে যাবে। ফলে নতুন করে আমনের বীজতলা করার সুযোগ পাওয়া যাবে। এ ছাড়া ভাসমান ও ট্রে পদ্ধতিতে বীজতলার পরিকল্পনা তো আছেই। বন্যা শেষ হলে আমরা কমিউনিটি বীজতলা করব।
মন্তব্য করুন