
প্রতারণার মামলায় মো. সাহেদকে বৃহস্পতিবার ঢাকার আদালতে হাজির করা হয়- সমকাল
'স্যার, আমি নিজেও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলাম। বাবা করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আমার এমডিও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় আমাকে এক মাস বাসায় থাকতে হয়েছে।' গতকাল বৃহস্পতিবার আদালতে এসব কথা বলে নিজের অনেক সাফাই গাইলেন আলোচিত বহুরূপী প্রতারক মো. সাহেদ। এর আগে ১৭ জুন ফেসবুকে এক পোস্টে সাহেদ বলেছিলেন, 'আমি করোনায় আক্রান্ত হয়েছি এবং আল্লাহর রহমতে সুস্থও হয়েছি।' তবে বিস্ময়কর তথ্য হলো- সাহেদ তার নিজের করোনা আক্রান্ত হওয়ার সনদ নিয়েও জালিয়াতি করেছেন। করোনা আক্রান্ত অন্যের স্যাম্পল নিজের নামে চালিয়ে সাহেদ করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সনদ নিয়েছেন। যদিও সত্যিই তিনি করোনায় আক্রান্ত হননি। সবার কাছে সহানুভূতি পাওয়া ও রিজেন্টের জালিয়াতি থেকে নিজেকে বাঁচাতে নিজের করোনা আক্রান্ত হওয়া নিয়েও এমন গল্প ফাঁদেন প্রতারণার গুরু সাহেদ। তদন্ত সংশ্নিষ্ট উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা গতকাল সমকালকে এ তথ্য জানান। সাহেদকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর করোনা সনদ নিয়ে এই জালিয়াতির তথ্য বেরিয়ে আসে।
জানা গেছে, করোনার ভুয়া সনদ তৈরি করতে করোনা সংক্রমিত একজন বিশ্বস্তকর্মীর কাছ থেকে নমুনা নিয়ে সাহেদ তার নমুনা বলে চালিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এরপর জাল করোনার সনদ তৈরি করা হয়। করোনা চিকিৎসার নামে রিজেন্টের কেলেঙ্কারির বিষয়টি ফাঁস হওয়ার আগেই তিনি বেশ কিছু কৌশল নেন। এর মধ্যে একটি ছিল করোনা টেস্টের জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত এমন আখ্যা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অনেক কর্মীকে ছাঁটাই করার নাটক। তাদের সাহেদ জানান, ছাঁটাই হলো লোক দেখানো। কথিত ছাঁটাইয়ের পর ওই কর্মীদের বাড়তি মাসে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হবে বলেও জানান সাহেদ।
তদন্ত সংশ্নিষ্ট একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এরই মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদে সাহেদ তার ৯ দিনের পলাতক জীবনের নাটকীয় বর্ণনা দিয়েছেন। সাহেদ জানান, ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পর গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি প্রভাবশালী অনেকের কাছে দেনদরবার করেন। তবে পরিস্থিতি তার প্রতিকূলে চলে গেছে এটা বুঝতে পেরে গা-ঢাকা দেন। প্রথমেই আখাউড়া সীমান্ত হয়ে ভারতে পালানোর চেষ্টা করেন। তবে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। আখাউড়া করে ট্রাকে করে আবার ঢাকায় ফেরেন। এক দিন কুমিল্লা থেকে নরসিংদীতে যাওয়ার পথে নাটকীয় ঘটনার জন্ম দেন সাহেদ। নিজের গাড়িতে যাওয়ার সময় হঠাৎ দেখেন সামনেই র্যাবের চেকপোস্ট। এরপর চালককে দ্রুত গাড়ি ঘোরানোর নির্দেশ দেন। মূল সড়কে না গিয়ে গ্রামমুখী একটি পথে চলে গিয়ে সেই যাত্রায় ধরা পড়ার হাত থেকে রক্ষা পান। তদন্ত সূত্র আরও জানায়, এক দিন পর একটি দামি গাড়ি নিয়ে কক্সবাজারের মহেশখালী যান তিনি। সেখানে তার এক বন্ধুর বাসায় পালিয়ে ছিলেন। পরে ওই গাড়ি রেখেই তিনি মহেশখালী ত্যাগ করেন। ধারণা করা হচ্ছে, সাহেদের ওই গাড়িটি মহেশখালীর কোনো জায়গায় পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। সাহেদ এটাও জানান, বাইরের লোকজনের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করতে সবসময় মাস্ক পরিহিত অবস্থায় থাকতেন। শেষমেশ সাতক্ষীরা সীমান্ত হয়ে ভারতে পালানোর চেষ্টা করেন।
হোল্ডিং নম্বর নিয়ে জালিয়াতি : তদন্ত সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, সাহেদের আরেকটি প্রতারণা ছিল- রাজধানীর সব বাড়ির হোল্ডিং নম্বর নিয়ে। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সাহেদ জানায়, ঢাকার সব বাড়ির নম্বর ঠিকঠাক করার জন্য সরকার তার প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিয়েছে। এ কাজ করার জন্য লোক নিয়োগ করতে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। পরে নিয়োগের নামে অনেকের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর উত্তরা পূর্ব থানায় মামলা হয়েছিল। তবে ওই মামলা তদবির করে সিআইডিতে নিয়ে যান সাহেদ। সেখানে দীর্ঘদিন মামলাটি হিমাগারে পড়ে ছিল। জানা গেছে, উত্তরা পূর্ব থানায় মামলার পর একজন পুলিশ কর্মকর্তার কাছে অখ্যাত পত্রিকার সাংবাদিকদের পাঠিয়ে সাহেদ প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন।
ওয়ারেন্ট মাথায় নিয়েই সব সামলাতেন : জানা যায়, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সবকিছু সামলে আসছিলেন সাহেদ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, কিছু ওয়ারেন্টে সাহেদের নাম-ঠিকানা ও বাবার নাম ভুল ছিল। তাই অনেক সময় ওয়ারেন্ট কার্যকর করতে সমস্যা হতো। আবার এটাও হতে পারে, কোনো পুলিশ সদস্য সাহেদের ওয়ারেন্ট তামিল করা নিয়ে গড়িমসি করতেন।
আদালতে কাঁদলেন সাহেদ : রিমান্ড শুনানির জন্য গতকাল সাহেদকে আদালতে হাজির করা হয়। রিমান্ড শুনানির সময় আদালতের কাছে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে সাহেদ বলেন, "পুলিশ ও র্যাব তার সঙ্গে 'অন্যায়' করেছে।" একজন আইনজীবী জানান, কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে শুনানির এক পর্যায়ে বাবার মৃত্যুর কথা বলে সাহেদ কেঁদে দেন। বলেন, 'সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রথম কভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় এগিয়ে এসেছি। সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছি। তখন অন্য কোনো হাসপাতাল সাড়া দিচ্ছিল না। হাসপাতাল থেকেই করোনা আমাকে ও আমার পরিবারকে সংক্রমিত করে। আমরা সেরে উঠি। হাসপাতালের নিবন্ধনের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য সোনালী ব্যাংকে টাকাও জমা দিয়েছে। কোনো অপরাধ করিনি। অন্যায়ভাবে র্যাব ও পুলিশ আমার হাসপালের বিভিন্ন শাখা সিলগালা করে দিয়েছে।' সাহেদের কান্না দেখে আইনজীবীরা বলেন, 'শান্ত হোন, আগেই এটা বোঝা উচিত ছিল আপনার।'
শুনানির এক পর্যায়ে সাহেদ পানি খেতে চাইলে বিচারক পানি অন্য একজনকে আগে পান করে পরীক্ষার পর সাহেদের হাতে বোতল দিতে বলেন। আদালতের একজন কর্মচারী তখন নিজে পরীক্ষা করে বোতল সাহেদের হাতে দেন।
সাহেদের আইনজীবী মনিরুজ্জামান রিমান্ডের বিরোধিতা করে বলেন, 'কোনো কথিত ভুক্তভোগী এ মামলা করেনি। এ মামলা করেছে পুলিশ। তার মক্কেল ষড়যন্ত্রের শিকার। কিন্তু সাহেদ সাধারণ জনগণকে উপকার করেছেন। তার অনেক শুভানুধ্যায়ী আছেন। যারা তার কাছে থেকে কোনো বিনিময় ছাড়া উপকৃত হয়েছেন।'
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আবু বলেন, 'এই সাহেদ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে। তার কারণে ইতালি থেকে বাংলাদেশি শ্রমিক, প্রবাসী কর্মীদের ফেরত আসতে হয়েছে। তিনি পরীক্ষা না করেই ভুয়া করোনা সার্টিফিকেট দিয়েছেন। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার। তারা একটা চক্র। এ চক্রের অন্যদের নাম-ঠিকানা জানতে আরও তথ্য উদ্ধারের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করতে ১০ দিনের রিমান্ডে দেওয়া হোক।'
এর আগে গতকাল সকাল ১০টার দিকে রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাহেদকে কোমরে মোটা দড়ি বেঁধে ঢাকার আদালতে হাজির করা হয়। আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি নিজের পক্ষে সাফাই গান। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত শুনানি নিয়ে সাহেদকে জিজ্ঞাসাবাদে ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। একই মামলায় রিজেন্ট হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ পারভেজকে ১০ দিন ও কর্মী তরিকুল ইসলামের সাত দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। আদালতে নেওয়ার সময় সাহেদের পরনে ছিল নীল রংয়ের শার্ট। শরীরে ছিল বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। মাথায় হেলমেট। চোখে কালো চশমা।
আদালতকে দেওয়া প্রতিবেদনে ডিবি জানায়, সাহেদ নিজেকে ক্লিন ইমেজের লোক বলে দাবি করত। তবে প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রকৃতপক্ষে সাহেদ একজন ধুরন্ধর, অর্থলিপ্সু ও পাষণ্ড প্রকৃতির লোক। অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার প্রশ্নে তার কাছে মানুষের জীবন-মৃত্যুর কোনো মূল্য নেই। সাহেদ তার সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট ও চিকিৎসা দেওয়ার নামে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সাহেদের প্রতারণার বিষয়টি জানার পর কোনো রোগী যদি প্রতিবাদ করতেন তাদের তিনি বিভিন্নভাবে হুমকি দিতেন। এর ফলে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পেতেন না। গত মার্চ মাস থেকে এখন পর্যন্ত সাহেদ করোনার ভুয়া রিপোর্ট ও চিকিৎসার প্রতারণার মাধ্যমে তিস-চার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার কথা স্বীকার : পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এরই মধ্যে সাহেদ করোনা নিয়ে ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, রিজেন্ট হাসপাতালে র্যাবের অভিযান শুরুর আগে কিছু মেশিনারিজ হাসপাতাল থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ডিবি ফের অভিযানে যাবে। এসব মেশিন কোথায় রাখা হয়েছে, তা খোঁজা হবে।
উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা জানান, উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর সড়কের একটি বাসা থেকে জাল টাকা উদ্ধারের ঘটনায় র্যাবের এক এসআই মামলা করেছেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে সাহেদকে। এ ছাড়া রিজেন্টের এমডি মাসুদ পারভেজসহ অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়েছে। এদিকে সাতক্ষীরার দেবহাটা থানায় অস্ত্র আইনে করা মামলারও প্রধান আসামি সাহেদ। নৌকার মাঝি বাচ্চু ছাড়া অজ্ঞাত আরও একজনকে ওই মামলার আসামি করা হয়েছে।
শাস্তির দাবিতে ময়মনসিংহে মানববন্ধন : ময়মনসিংহ ব্যুরো জানায়, করোনার ভুয়া সনদ প্রদান, নকল ওষুধ ও নিম্নমানের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহের দায়ে অভিযুক্ত মো. সাহেদ ও জেকেজির কর্ণধার ডা. সাবরিনাসহ দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে ময়মনসিংহের কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন। গতকাল নগরীর ফিরোজ-জাহাঙ্গীর চত্বরে মানববন্ধন চলাকালে একাত্মতা প্রকাশ করে বক্তব্য দেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল, ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক অমিত রায়, বাংলার মুখ সভাপতি অধ্যাপক দিলরুবা শারমিন, জনউদ্যোগ সভাপতি অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম চুন্নু, পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শিব্বির আহমেদ লিটন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অ্যাডভোকেট আব্দুল মোত্তালিব লাল, সজল কোরায়শী প্রমুখ।
মন্তব্য করুন