রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ শুক্রবার ৮৭ বছর বয়সে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। সমকালের শুরু থেকেই তিনি নিয়মিত কলাম লেখক ছিলেন। তার সর্বশেষ নিবন্ধ 'করোনা দুর্যোগ ও উপনির্বাচন' প্রকাশ হয় ৮ জুলাই। সমকালের পাঠকদের জন্য নিবন্ধটি পুনরায় প্রকাশ করা হলো।


করোনাদুর্যোগ সমগ্র বিশ্বে অন্ধকারাচ্ছন্ন এক নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। তবে আমাদের দেশে এরই সঙ্গে আরও কিছু ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে দুটি কারণে। এক. ঘূর্ণিঝড় আম্পান অনেক ক্ষত সৃষ্টি করে গেছে। দুই. বন্যা। বলা যায় সব মিলিয়ে আমরা বড় সংকটেই নিপতিত। বন্যার সঙ্গে এদেশের মানুষের বসবাসের ভিন্ন অভিজ্ঞতাও রয়েছে। আমরা যে প্রায় প্রতিবছরই এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে থাকি, এর জন্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা কাঠামোগত পরিকল্পনার চেয়ে অবকাঠামোগত দিকটিক ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করে এলেও এক্ষেত্রে জুতসই কাজ হচ্ছে না।

আমরা যখন এ রকম বড় সংকটের মধ্যে নিপতিত, তখন জাতীয় সংসদের শূন্য দুটি আসনে স্থগিত উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে তা সমালোচনার খোরাক জুগিয়েছে। করোনাকালে এই উপনির্বাচনকে অনেকেই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলেও অভিহিত করেছেন। এসবের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের যৌক্তিকতাও আছে। একই সঙ্গে এমন কার্যক্রম প্রশ্নেরও বিষয় হয়ে উঠেছে। বগুড়া-১ ও যশোর-৬ আসনে উপনির্বাচন এই দুর্যোগকালে অনুষ্ঠানের আয়োজন না করে বিকল্প পথে হাঁটা যেত কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আমরা যদি একটু পেছনের দিকে তাকাই, তাহলে স্মরণ করতে পারি ঢাকা-১০, গাইবান্ধা-১, বাগেরহাট-৪ আসনে ভোটগ্রহণের বিষয়টি। একই সঙ্গে স্মরণ করতে পারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের বিষয়টিও। কভিড-১৯-এর সংক্রমণ আমাদের দেশে ঘটতে শুরু করে মার্চের প্রথম দিক থেকে। এর কিছুদিন পরই দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যায়। শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার শর্তগুলো আরোপিত হতে থাকে।

পরিস্থিতির যখন ক্রমেই অবনতি ঘটতে থাকে, তখন গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর পরিসরও বাড়তে থাকে। এমতাবস্থায় ওই নির্বাচনগুলোর সিদ্ধান্ত নানা মহলে সঙ্গতই নেতিবাচক আলোচনার খোরাক জোগায়। আমাদের অনেকেরই এও ভুলে যাওয়ার কথা নয়, এই সমালোচনার মুখে প্রথমে তিনটি সংসদীয় আসনে উপনির্বাচন হলেও দ্বিতীয় দফায় অন্য দুটি সংসদীয় আসন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিত করতে বাধ্য হয় নির্বাচন কমিশন। জনসমাগম এড়িয়ে চলা যেখানে করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার অন্যতম একটি উপায় হিসেবে বিবেচিত-চিহ্নিত বিষয়, সেখানে নির্বাচনের মতো অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে জনসমাগমের চিন্তাটা বিজ্ঞজনদের কাছে অবিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্ত হিসেবে সমালোচিত হচ্ছে। গণতন্ত্রে নির্বাচন মানে উৎসব (যদিও সেই উৎসব নানা কারণে অনেকটাই ম্লান হয়ে পড়েছে)। অনেকেই ব্যঙ্গ করে বলে থাকেন, অনেক ক্ষেত্রেই অকারণে 'আত্মঘাতী' সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমাদের নীতিনির্ধারক অনেকেরই জুড়ি নেই। আমি সেই বিতর্কে যাব না। এখন কোনো বিতর্কের সময় নয়।

এখন পর্যন্ত করোনাদুর্যোগ পরিস্থিতির উন্নতি তো ঘটেইনি; উপরন্তু অবনতির চিত্রটাই যেখানে প্রকট, সেখানে স্থগিত নির্বাচন আবার গ্রহণ করার উদ্যোগ নেওয়ায় সংবাদ মাধ্যমেও সমালোচনার ঝড় ওঠে। করোনা সংক্রমণের বিস্তৃতি ঘটে চলেছে এবং এর বহুমুখী বিরূপ প্রভাব পড়েছে জনজীবনে। রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার উপকণ্ঠ ছাপিয়ে এখন এই সংক্রমণের বিস্তৃতি সারাদেশেই কমবেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে যা আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। করোনাদুর্যোগকালে উপনির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়ে কঠোর সমালোচনা হলেও নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত তাদের গৃহীত সিদ্ধান্তে অটল। তবে বিদ্যমান বাস্তবতা এমন সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার তাগিদই দিচ্ছে এবং তা উপেক্ষণীয় বিষয় হয়ে থাকতে পারে না। এমন আয়োজন যদি সংক্রমণের ক্ষেত্র আরও (এমন আশঙ্কাই প্রকট) বিস্তৃত করে এবং যদি প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ায়, তাহলে নির্বাচন কমিশনের দায় এড়ানোর কোনো পথই থাকবে না।

নির্বাচন কমিশনের তরফে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলা হয়েছে। আমাদের সংবিধানে উল্লেখ আছে, আসন শূন্য হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। কোনো কারণে তা সম্ভব না হলে এর পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। সেই নিরিখে ১৮০ দিন অতিক্রম করার খুব একটা বাকি নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- দেশে যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মানবিক সংকট দেখা দেয় এবং এর কারণে যদি নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব না হয়, তা হলে কি সংবিধানের ব্যত্যয় ঘটবে? এ নিয়ে তর্ক হতে পারে; কিন্তু যতদূর জানি এমন পরিস্থিতিতে অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষায় কোনো বাধা নেই। আমাদের দায়িত্বশীল কিংবা নীতিনির্ধারকরা দুর্যোগকালীন সংকটে করণীয় সম্পর্কে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন; নির্দেশনা নিতে পারেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান অন্যতম অনুষঙ্গ বটে; কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে জাতির কল্যাণে সিদ্ধান্ত নেওয়া বাঞ্ছনীয়। সংবিধানে সংশোধনী আনা হয় প্রয়োজনের নিরিখেই। এটা শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশেই এর নজির আছে।

করোনাদুর্যোগকালে অনুষ্ঠিত কয়েকটি নির্বাচনের চিত্র আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠছে। নগণ্যসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতিতে ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে যে চিত্র আমরা দেখেছি, তা গণতন্ত্রের জন্য কতটা কল্যাণকর- সেই প্রশ্নটাও তো উত্থাপন করা যায়। অবাধ, স্বচ্ছ, প্রশ্নমুক্ত সর্বোপরি নূ্যনতম প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতিই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনের অন্যতম অলংকার। ঘোষিত তারিখে বগুড়া-১ ও যশোর-৬ আসনে উপনির্বাচন যদি নির্বাচন কমিশন অনুষ্ঠিতই করে, তাহলে এর যে পুনর্বার ব্যত্যয় ঘটবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে জনমতের যথাযথ প্রতিফলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সেই আশা আমরা করি কী করে? এখন যদি নীতিনির্ধারকরা বলেন- জনসমাগম কম থাকলে সংক্রমণের ঝুঁকিও কম থাকবে, তাহলে তা হবে আরও কিছু জরুরি প্রশ্ন উত্থাপন ও উদ্বেগের কারণ।

জীবনের মূল্য অপরিসীম- এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নতুন করে নিষ্প্রয়োজন। নাগরিকের নিরাপত্তাসহ জীবনের সব সৌন্দর্য কিংবা ছন্দ রক্ষা করা রাষ্ট্রশক্তি ও তার অনুষঙ্গ শক্তিগুলোর অন্যতম দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রশক্তিসহ অনুষঙ্গ সব শক্তি বাধ্যও। গণতন্ত্রে জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তারিখ অনুযায়ী উপনির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ৫ জুলাই বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কোনো কোনো সমালোচক প্রশ্ন তুলেছেন- এমন পরিস্থিতি না হলে বিএনপি কি নির্বাচনে অংশ নিত? এখন এই বিতর্কে জড়ানো নিরর্থক। তবে আমি মনে করি প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলেরই নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত। তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক ও যোগাযোগের বিষয়টি সুদৃঢ় করতে এর কোনো বিকল্প নেই।

করোনাদুর্যোগ পরিস্থিতিকে বিবেচনায় রেখে এই মুহূর্তে কোনো নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তের বিষয়টিকে আমরা যে দৃষ্টিকোণ থেকে, যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই দেখি না কেন বর্তমান বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তা হয়তো বেঠিক নয়। তবে কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলেরই নির্বাচন (দুর্যোগকালীন পরিস্থিতির কথা ভিন্ন) বর্জন করা অনুচিত। দল ও গণতন্ত্রের বিকাশের স্বার্থ কিংবা প্রয়োজনেই এমনটি বাঞ্ছনীয়। নির্বাচনী ব্যবস্থার ত্রুটি, গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর ইত্যাদি যে কোনো বিষয়ে যে কোনো কারোর নেতিবাচক কর্মকাণ্ডও ঠেকাতে হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তাও ঠিক করতে হবে সেই নিরিখেই।

বিষয় : ড. এমাজউদ্দিন অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ

মন্তব্য করুন