- বাংলাদেশ
- জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ভ্রমণ নয়
সরকারি চাকরিজীবীদের বিদেশ সফরে পরিপত্র
জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ভ্রমণ নয়

গত বছরের ডিসেম্বরে আইন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা অস্ট্রেলিয়ার সিডনির এক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ নিতে যান। ওই সময়ে বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব ওয়েস্টার্ন বিজয় দিবস উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে ওই কর্মকর্তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অনুষ্ঠানে এক প্রবাসী শিক্ষার্থী বাংলাদেশি কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেন, 'আপনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ নিতে এসেছেন।' ওই কর্মকর্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটি বলতে পারেননি।
সরকারি টাকায় নানা ছুতোয় বিদেশ ভ্রমণ করছেন কর্মকর্তারা। কখনও প্রশিক্ষণ, কখনও কর্মশালা, আবার কখনও যন্ত্র ও কলাকৌশল দর্শন ইত্যাদি অজুহাতে বিদেশে যাচ্ছেন। এতে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় হচ্ছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, করোনাকালে ব্যয় সংকোচন করার লক্ষ্যে সরকারি চাকরিজীবীদের বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ কঠোর করা হয়েছে। এ বিষয়ে গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে পরিপত্র জারি করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, চলমান ব্যয় সংকোচন নীতির অংশ হিসেবে এ পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এখন পরিপত্র জারি করে তা কার্যকর করা হলো। তিনি বলেন, নিতান্তই প্রয়োজন ছাড়া এখন থেকে কাউকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে না। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ খাতে বছরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করার ফলে এ খাতে অন্তত ৫০ ভাগ অর্থ সাশ্রয় হবে।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সরকারি চাকরিজীবীরা বিদেশ ভ্রমণ করেন। এতে রাষ্ট্রীয় অর্থের ব্যাপক অপচয়। এ খাতে তদারকি ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআইএর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, দেশে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে ভ্রমণে 'অতিরিক্ত' ব্যয়ের প্রবণতা আছে। অনেক অপ্রয়োজনীয় ব্যয় করা হয়। এটি অবশ্যই বন্ধ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। সরকারি বিদেশ ভ্রমণনীতি খুবই উদার- এ কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, প্রাধিকারভুক্ত সব সরকারি কর্মকর্তা বিমানে বিজনেস ক্লাসে যাতায়াতের সুবিধা পান। জনপ্রশাসনে এদের সংখ্যা অনেক। ফলে এ খাতে প্রতিবছর বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে ভ্রমণ ব্যয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এ খাতে তদারকি ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, শুধু জরুরি ও অপরিহার্য ক্ষেত্র বিবেচনায় ভ্রমণে অর্থ ব্যয় করা যাবে। এর বাইরে খরচ করা যাবে না। সরকারি ভ্রমণের ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে বরাদ্দকৃত অর্থের ৫০ শতাংশ স্থগিত থাকবে। এ ছাড়া সব ধরনের রুটিন ভ্রমণ পরিহার করতে হবে। অবিলম্বে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে এবং পুনরায় আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে- উল্লেখ করা হয় পরিপত্রে।
সূত্র জানায়, শুধু প্রশিক্ষণ নয়, ক্যামেরা কেনা, পুকুর খনন পরিদর্শনের নামে কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের ঘটনা ঘটেছে। মন্ত্রণালয়ের টাকায় সংসদীয় কমিটির বিদেশ সফর, প্রকল্পের টাকায় ব্যক্তিগত বিদেশ সফর, শিক্ষা সফরের নামে প্রমোদ ভ্রমণ- এ রকম অসংখ্য নজির আছে। একটি সূত্র জানায়, নিম্ন আদালতের বিচারকদের বিচারিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আইন ও বিচার বিভাগ অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অংশীদারত্বমূলক স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করেছে। এই প্রকল্পের অধীনে ধাপে ধাপে প্রায় ৫৪০ জন বিচারককে প্রশিক্ষণের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানো হচ্ছে। এরই মধ্যে আলোচ্য প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর নিয়ে সরকারের নীতিমালা বা নির্দেশনা রয়েছে। সেসব নিয়ম-নীতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। যে যেভাবে পারছেন বিদেশ সফরের কর্মসূচি বাগিয়ে নিচ্ছেন। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব থেকে শুরু করে প্রশাসনের মূল কর্তাব্যক্তি সচিব পর্যন্ত প্রত্যেকেই বিদেশ যাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বিশেষ করে প্রভাবশালী বা ক্ষমতাবানরা সফর প্রস্তাব আসার সঙ্গে সঙ্গেই লুফে নিচ্ছেন। এমনকি কারও কারও মধ্যে বিদেশ সফরের প্রবণতা এক ধরনের বাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা যাচ্ছে, বিদেশ থেকে ঘুরে আসার আগেই আরেকটি সফর কর্মসূচি তৈরি করে রেখেছেন। কোনো কোনো কর্মকর্তার বছরে ১২ বারেরও অধিক বিদেশ সফরের রেকর্ড রয়েছে। এসব সফরে তার যাওয়া উচিত কি উচিত না, নীতিমালায় পড়ে কিনা- কিছুই বিবেচনা করছেন না। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, এখন থেকে বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে প্রতিটি প্রস্তাব কেস টু কেস পর্যালোচনা করে অর্থছাড়ের অনুমিত দেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন