ক'দিন আগেও রাজধানীর গুলশান-১-এর একটি সুপারশপের 'অ্যাঞ্জেল শেফ' নামের অংশটি মুখর ছিল ক্রেতা-বিক্রেতার পদচারণায়। ক্রেতারা সাধারণ হলেও বিক্রেতারা ছিলেন একটু অন্যরকম। তাদের মধ্যে কেউ শারীরিক, কেউ স্নায়বিক প্রতিবন্ধী বা অটিস্টিক, কেউ আবার ছিলেন শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী। অথচ সবাইকে অবাক করে দিয়ে তারাই সার্বক্ষণিক খাবার তৈরি, বিতরণ, বিক্রিসহ পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তাদের দক্ষতায় এ অংশটিতে ভিড় লেগে থাকত প্রায় সব সময়ই। অথচ করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে সেই বিক্রয়কর্মীদের কাউকেই আর দেখা যাচ্ছে না এখন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, অটিজম রয়েছে এমন মানুষকে বছরের পর বছর প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের বিশেষ বিশেষ কাজে দক্ষ করে তুলেছিল পিএফডিএ-ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার। এটি পিএফডিএ-ভিটিসি নামেই পরিচিত। অথচ করোনা মহামারিতে আর্থিক সংকটের কারণে তাদের সাময়িক চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তিন মাস বেকার হয়ে ঘরে অলস সময় কাটাচ্ছেন এই আউটলেটের ২৪ জন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তি।

ওই সুপারশপের বিক্রয়কর্মী স্নায়বিক প্রতিবন্ধী ২৩ বছর বয়সী ইনজামুল হকের পরিবারের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তার মা-বাবা কোনোদিন ভাবতেও পারেননি, তাদের এই সন্তানের আয় করা টাকা দেখতে পাবেন তারা। ইনজামুল ২০১৭ সাল থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শুরু করলেও ২০১৮ সালের মে মাসে প্রথম উপার্জন করেন। তিনি বেতনের টাকা মায়ের হাতে তুলে দেওয়ার পর খুশিতে কেঁদে ফেলেছিলেন তার গর্ভধারিণী। ইনজামুলের মা সামিনা ইয়াসমিন বলেন, ওর বাবা একজন ছোটখাটো ব্যবসায়ী। করোনার জন্য লোকজন বের হচ্ছে না, তাদেরও ব্যবসাপাতি ভালো হচ্ছে না। তাই চারজনের (এক বোনসহ) পরিবার আর্থিক সংকট রয়েছে। ওর কাজটা থাকলে তাদের একটু স্বস্তি লাগত, পাশাপাশি সেও কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকত।

ইনজামুলের বাকি সহকর্মীরাও এখন কর্মহীন হয়ে ঘরে বসে সময় কাটাচ্ছেন। তারাও হয়তো ভাবছেন, কবে করোনাকাল শেষ হবে? কবে আবার খুলবে তাদের সুপারশপ, কবে আবার সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা হবে! আবারও মা-বাবা, স্বজনদের হাতে মাস শেষে নিজের আয়ের টাকা তুলে দিতে পারবেন।

অ্যাঞ্জেল শেফের হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং অটিজম নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষদের কী অবস্থা এই সংকটময় পরিস্থিতিতে, সেটা নিয়েই কথা হয় পিএফডিএর প্রতিষ্ঠাতা সাজিদা রহমান ড্যানির সঙ্গে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের স্বাবলম্বী করতে কর্মমুখী প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যই তিনি পিএফডিএ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান এবং অ্যাঞ্জেল শেফের উদ্যোক্তা।

সাজিদা জানান, বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের মূলধারার কর্মস্রোতে সম্পৃক্ত করতেই দেশে প্রথম অ্যাঞ্জেল শেফ যাত্রা শুরু করে। পিএফডিএর শিক্ষার্থীরা ২০১৫ সালে বেকারি ও ফুড সার্ভিসের ওপর প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর থেকেই অ্যাঞ্জেল শেফ বাজারে বেকারি পণ্য নিয়ে আসে। নিজেদের গুণগত মানের পরিচয় দিয়ে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে এখন পর্যন্ত 'অ্যাঞ্জেল শেফ' একটি প্রোডাকশন সেন্টার, একটি 'হট কিচেন' ও ৯টি আউটলেট পরিচালনা করতে পেরেছে। কাজের ভিত্তিতে ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারের পক্ষ থেকে একেকজনকে পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন দেওয়া হয়। তবে চলমান সংকটে এই উদ্যোগ চালিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে গত তিন মাস অ্যাঞ্জেল শেফের ২৭ কর্মীর মধ্যে ২৪ জনকে সাময়িকভাবে বসিয়ে রাখা হয়েছে। কারণ আর্থিক সংকট। লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে ক্রেতারা আর আউটলেটগুলোতে আসেন না। বিক্রিতে ভাটা পড়ায় তাদের বেতন দেওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। তার পরও অ্যাঞ্জেল শেফের কর্মীদের এক মাসের বেতন ব্যক্তিগত সঞ্চয় থেকে দিয়েছেন তিনি।

তিনি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, 'আমরা ওদের হতাশ হতে দেবো না। অবস্থার পরিবর্তন হলেই ওরাই আবার আগের জায়গায় ফিরে কাজে যোগ দেবে। কারণ ওদের প্রত্যেককে প্রশিক্ষণ দিয়ে আমরা তৈরি করেছি। ওদের দক্ষ করে নিজের পায়ে দাঁড় করানোটাই আমাদের লক্ষ্য।'

জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন বলছে, বর্তমানে দেশে ১৬ লাখ ৭৯ হাজার প্রতিবন্ধী রয়েছে এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে প্রায় শতভাগ প্রতিবন্ধীকে ভাতার আওতায় আনা হয়েছে। তাদের প্রতি মাসে ৭৫০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ৭০০ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত উপবৃত্তি দেওয়া হয়।

কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী সুমাইয়া সুলতানার (২৬) কথাই ধরা যাক। নিজের চেষ্টায় সামাজিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে হার মানিয়েছেন তিনি। একটা চাকরিও পেয়েছিলেন। আট হাজার টাকা বেতন পেতেন। কিন্তু করোনার কারণে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায়িক সংকটে পড়ে, আর সুমাইয়াকেও চাকরিটা হারাতে হয়।

সুমাইয়ার বাবা সাইদুল ইসলাম সমকালকে বলেন, 'সরকার থেকে যে প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হয়, সেটি খুবই সামান্য। এই সংকটময় সময়ে তার মেয়ের মতো যারা আছে, তাদেরই সমস্যা বেশি। ছাঁটাই হলে সবার আগে তারাই হচ্ছে। আর তাই তিনি নিজের সন্তানসহ অন্যসব বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য এই করোনাকালে আর্থিক সুবিধা প্রদানের দাবি জানিয়েছেন। বেসরকারি খাতেও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বারবারই বলছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিপদের এখানেই শেষ নয়, বরং শুরু। চলমান অর্থনৈতিক অবস্থায় আয়-রোজগার কমেছে বহু পরিবারের, কারও কারও বন্ধ হয়ে গেছে উপার্জনের পথ। এমন পরিস্থিতিতে কোনো পরিবারে এমন একজন সদস্য থাকলে তাকে বোঝা বলে মনে হওয়াটা অসম্ভব নয়। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পরিবারের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সদস্যটির কোনো রকম আয়ের সংস্থান থাকে না। তার কোনো অসুখ থাকলে বা নিয়মিত পরিচর্যার জন্যও বাড়তি অর্থের দরকার পড়ে। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক সংকট শুধু অর্থতেই নয়; বরং সামাজিক ও পারিবারিক সংকটেও রূপ নিতে পারে।

এ সংকটে তাদের সহযোগিতা করতে সরকারও উদ্যোগী। করোনা সংক্রমণ শুরুর পর প্রধানমন্ত্রীর যে ৩১ দফা নির্দেশনা দেন তাতে প্রতিবন্ধীদের প্রতি আলাদা করে মনোযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

আশার আলো দেখাচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগ : তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান প্রেরণা ফাউন্ডেশন পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে ক্ষমতায়ন করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠানটি সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে মূলধারার কর্মস্রোতে অন্তর্ভুক্ত করে দারিদ্র্য দূর করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। সেই পরিকল্পনারই অংশ হিসেবে সম্প্রতি পিএফডিএফের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে অটিজমে ভোগা মানুষের প্রশিক্ষণ ও বিকল্প কর্মসংস্থান করতে 'আমরা শিখি আমরা পারি' কার্যক্রম শুরু করেছে।

প্রেরণা ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী আনোয়ারুল আমিন জানান, অটিজমে আক্রান্তদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলা এবং কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তাদের মূলধারার কর্মস্রোতে অন্তর্ভুক্ত করে স্বনির্ভর জীবন গড়ে দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কাজ করছে তার প্রতিষ্ঠান। আর এজন্য তাদের সহযোগিতা দরকার। চলমান সংকট তাদের ওপরও প্রভাব ফেলেছে। প্রেরণা ফাউন্ডেশন তাই তাদের জন্য বিকল্প দক্ষতা তৈরি করে অর্থ আয়ের পথ খোলার জন্য 'আমরা শিখি আমরা পারি' প্রকল্প শুরু করে।

তিনি বলেন, শুধু করোনার সংকটেই নয়, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নে প্রেরণা ফাউন্ডেশনের রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। তিনি আরও বলেন, 'আমরা সরকারের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে চাইছি। দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ সরকার যেন এসডিজি অর্জনে সফল হয়, সেটাই আমাদের প্রধানতম লক্ষ্য। বাংলাদেশের টেকসই লক্ষ্যমাত্রার সবক'টি লক্ষ্য অর্জনের দৃশ্যমান অগ্রগতি তখনই হবে যখন আমরা সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকেও সামনের কাতারে এনে দাঁড় করাতে পারব।'