বেসরকারি খাতের তৃতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের নয়াবাজার শাখায় চারটি ডিপিএস আছে লাকী আক্তারের। এর মধ্যে দশ বছর মেয়াদি একটি ডিপিএস নয় বছর আগে। পরে আরও তিনটি খুলেছেন বিভিন্ন মেয়াদে। করোনা সংকটে বাসা থেকে বের না হওয়ায় কারণে এপ্রিল, মে ও জুন মাসের কিস্তির টাকা নিয়ে গত ৩ জুলাই ব্যাংকে যান তার স্বামী। তবে টাকা জমা না নিয়ে শাখা থেকে জানানো হয়, টানা তিন মাস বকেয়া পড়ায় তার সবক'টি ডিপিএস বন্ধ হয়ে গেছে। এখন জমা টাকার ওপর সঞ্চয়ী সুদহারে তাকে টাকা তুলে নিতে হবে। তিনি তাতে সাড়া না দিয়ে বাসায় ফিরে যান। পরে এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সংশ্নিষ্ট ব্যাংকের এমডিসহ বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগের পর শেষ পর্যন্ত গত ১৩ জুলাই জরিমানাসহ কিস্তির টাকা জমা দিয়ে সবক'টি ডিপিএস সচল করতে সক্ষম হয়েছেন লাকী আক্তার।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ঋণে সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেওয়ার পর ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদে আর আমানত নিচ্ছে না। কোনো নোটিশ ছাড়া বেশি সুদের ডিপিএস বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। কেননা অনেক ক্ষেত্রে পুরাতন আমানতের মেয়াদপূর্তির আগে সুদহার পরিবর্তনের সুযোগ নেই। অনেক ব্যাংক বেশি সুদের ডাবল বেনিফিট, লাখপতি, কোটিপতির মতো বিশেষ স্কিম বন্ধ করে দিয়েছে। খরচ কমাতে গিয়ে নানা উপায়ে আমানতকারী ঠকাচ্ছে ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, আমানতকারীরা এখন অসহায় হয়ে পড়েছে। ব্যাংকে একটি চুক্তির বিপরীতে আমানত রাখা হয়। ফলে মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংক কোনোভাবে তা ভাঙ্গিয়ে দিতে পারে না। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ বিষয়ে কঠোর নজদারি থাকা উচিত। ব্যাংকগুলো হয়তো মনে করছে, ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন এবং করোনার প্রভাব মোকাবিলায় প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের দোহাই দিয়ে আমানতকারীদের ঠকালে কেউ ধরবে না। ব্যাংকগুলোর আদৌ এটা ঠিক হচ্ছে না। কেননা এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তারল্য সহায়তা দেওয়ায় হয়তো তহবিলের জন্য সমস্যা হচ্ছে না। তারল্য সহায়তা বন্ধ করলে তখন সমস্যা হবে। তাই এই উপায়ে খরচ না কমিয়ে বরং উচ্চ সাজসজ্জা, বাড়ি ভাড়া, বিনোদন, গাড়ি, পরিচালকদের সম্মানীসহ নানা খাতে খরচ কমাতে হবে।
চলতি ও সঞ্চয়ী হিসাবের তুলনায় ডিপিএস বা এফডিআরে দুই থেকে তিনগুণ বেশি সুদ দেয় ব্যাংকগুলো। অধিকাংশ ব্যাংক গত ১ এপ্রিল থেকে মেয়াদি আমানতে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। অথচ চলতি সঞ্চয়ী হিসেবে দিচ্ছে মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ। সাধারণত মেয়াদ যত বেশি থাকে তত বেশি সুদ অফার করে ব্যাংকগুলো। গত বছর ১০ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদে মেয়াদি আমানত নিয়েছে অনেক ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, লিখিতভাবে কোনো অভিযোগ এলে বাংলাদেশ ব্যাংক অনিয়ম হয়েছে কিনা খতিয়ে দেখবে। তবে দুটি দিকই দেখতে হবে। আগে যেসব ঋণের সুদহার ১৫, ১৬ এমনকি ১৭ শতাংশও ছিল; এখন ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। অথচ পুরাতন মেয়াদি আমানতে আগের মতোই সুদ দিতে হচ্ছে। যে কারণে হয়তো গ্রাহককে বুঝিয়ে বেশি সুদের আমানত বন্ধ করতে পারে। তবে জোর করে বা নিয়মবহির্ভূতভাবে কোনো ব্যাংক আমানত বন্ধ করে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুর পর বাংলাদেশ ব্যাংক গত মার্চের মাঝামাঝি থেকে ঋণ গ্রহীতা ও ব্যাংকের জন্য বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে একের পর এক সার্কুলার জারি করলেও আমানতকারীরা ছিলেন এসবের বাইরে। পরে বিভিন্ন পক্ষের অনুরোধে গত ১ জুন একটি সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই নির্দেশনায় বলা হয়, এপ্রিল ও মে মাসের কিস্তি দেরিতে জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বিলম্ব ফি, চার্জ বা অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা যাবে না। কোনো ব্যাংক জরিমানা নিয়ে থাকলে সংশ্নিষ্ট আমানতকারীকে তা ফেরত দিতে হবে। আর করোনাভাইরাসের এ সময়ে কোনো সঞ্চয়ী স্কিমের কিস্তি পরিশোধে অসমর্থতার কারণে তা বন্ধ বা বাতিল করা যাবে না। তবে কোনো কোনো ব্যাংক এই নির্দেশনা অমান্য করে আমানত হিসাব বন্ধ করে দিচ্ছে। আগে নেওয়া জরিমানা ফেরত দিচ্ছে না কোনো কোনো ব্যাংক।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, কোনো ব্যাংক এমন করছে কিনা তিনি জানেন না। ডিপিএস মেয়াদপূর্তির আগে কেউ ভাঙ্গালে সাধারণভাবে সঞ্চয়ী হারে সুদ দেওয়া হয়। এতে ওই ব্যাংকের খরচ অনেক কমে যায়। এ কারণে কোনো ব্যাংক হয়তো এরকম করে থাকতে পারে। অবশ্য ডিপিএস শুরুর সময় গ্রাহকের সঙ্গে ব্যাংকের চুক্তিনামায় টানা কত মাস কিস্তি না দিলে বন্ধ হবে তা উল্লেখ থাকে। তবে করোনাভাইরাসের মহামারি শুরুর পর এই সময়ে কেউ কিস্তি না দিলেও ডিপিএস বন্ধ না করার নির্দেশনা রয়েছে।
ব্যাংকাররা জানান, করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুর আগেই ব্যাংকগুলো সুদহার নিয়ে চাপে ছিল। এর মধ্যে করোনা মহামারির কারণে আমদানি, রপ্তানিসহ ব্যাংকের নন-ফান্ডেড ব্যবসা ব্যাপক কমেছে। এ অবস্থায় কোনো কোনো ব্যাংক বেশি সুদের আমানত কমিয়ে ব্যয় কমাতে চাইছে। অবশ্য গ্রাহকের সঙ্গে চুক্তিতে সাধারণত টানা তিন বা ছয় মাস কেউ কিস্তি না দিলে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার কথা উল্লেখ থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যাংক এখন তা পারবে না। সাধারণ সময়ে ব্যাংকের তারল্য কম থাকলে অনেক ক্ষেত্রে এক বছর বা আরও বেশি সময় ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ ডিপিএস চালুর জন্য ব্যাংক থেকে গ্রাহককে ফোন দেওয়া হয়।


বিষয় : ডিপিএস বন্ধ

মন্তব্য করুন