- বাংলাদেশ
- অনলাইন বুলেটিন বন্ধের নেপথ্যে সমন্বয়হীনতা
অনলাইন বুলেটিন বন্ধের নেপথ্যে সমন্বয়হীনতা
২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত ২৯৯৬, মৃত্যু ৩৩

করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত অনলাইন বুলেটিন বন্ধ হয়ে গেল। আজ বুধবার থেকে এই বুলেটিন আর সম্প্রচার হবে না। এর পরিবর্তে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে করোনার সংক্রমণ সংক্রান্ত তথ্য গণমাধ্যমে পাঠানো হবে। গতকাল মঙ্গলবার শেষবারের মতো বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা এ তথ্য জানান। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে শুরুতে সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলন চলছিল। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি সামনে এলে একপর্যায়ে অনলাইন সংবাদ সম্মেলন শুরু হয়। সেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল। কিন্তু গত ৮ এপ্রিল থেকে সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুযোগ বন্ধ করে প্রতিদিন দুপুর আড়াইটায় বুলেটিন চালু করা হয়েছিল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয়হীনতাই বুলেটিন বন্ধের কারণ বলে সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এ বুলেটিন বন্ধ করা যথাযথ হয়নি বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি সমকালকে বলেন, অনলাইন বুলেটিনের মাধ্যমে করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে মানুষকে জানানো হতো। এতে মানুষ আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য পেতেন। এখন সেটিও বন্ধ করা হয়েছে। এটি যৌক্তিক হতে পারে না। তথ্য নিয়ে লুকোচুরি ও গণমাধ্যমের মুখোমুখি হতে ভয় পাওয়া কিংবা এড়িয়ে চলার চেষ্টা সততার লক্ষণ নয়। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এ ধরনের কাজ যখন শুরু করে তখন মনে করতে হবে তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি লুকাতে চাইছে অথবা করতে চাইছে।
সংবাদ সম্মেলন যেভাবে বুলেটিন হলো :দেশে করোনাভাইরাস সম্পর্কিত হালনাগাদ তথ্য জানাতে গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলন শুরু করে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা করোনা সম্পর্কিত তথ্যউপাত্ত উপস্থাপনের পাশাপাশি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও উত্তর দিতেন। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ার পরও আইইডিসিআর পরিচালকই ব্রিফ করে আসছিলেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদও মাঝে মধ্যে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হতেন। নমুনা পরীক্ষা নিয়ে সমালোচনার মুখে চাপে পড়েন আইইডিসিআর পরিচালক। অভিযোগ ওঠে, সংবাদ সম্মেলনের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে নমুনা পরীক্ষা, কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং ও রোগতাত্ত্বিক গবেষণায় সময় দিতে পারছেন না তিনি। এ কারণে রোগটি ছড়িয়ে পড়ছে। বিষয়টি উপলব্ধি করার পর চাপ কমাতে আইইডিসিআর পরিচালকের সঙ্গে এমআইএস পরিচালক ডা. হাবিবুর রহমান ব্রিফিংয়ে যুক্ত হন। করোনার নমুনা পরীক্ষার পরিধিও বাড়ানো হয়।
এরই মধ্যে গত ২ এপ্রিল করোনার নমুনা পরীক্ষা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ভুলভাবে উপস্থাপন করেন ডা. হাবিবুর রহমান। এরপর নিয়মিত ব্রিফিংয়ে তথ্য উপস্থাপনের কাজ থেকে তাকে বিরত রাখা হয়। ৩ এপ্রিল থেকে যুক্ত হন মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ। ওই সময়ে একদিন পরপর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও অনলাইন ব্রিফিংয়ে যুক্ত হতেন। এরই মধ্যে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সর্বশেষ পরিসংখ্যান তুলে ধরে চারজনের মৃত্যুর তথ্য জানান। পরে আইইডিসিআর পরিচালক জানান, প্রকৃতপক্ষে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ ধরনের সমন্বয়হীনতায় সর্বত্র সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এর একদিন পর ৭ এপ্রিল অনলাইন বিফ্রিং স্থগিতের ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর ৮ এপ্রিল থেকে অনলাইন ব্রিফিং অনলাইন বুলেটিনে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
আইইডিসিআর থেকে নিয়ন্ত্রণ পায় অধিদপ্তর :আইইডিসিআর থেকে বুলেটিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চলে যায়। অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা শুরুতে কয়েকদিন ওই বুলেটিনে অংশ নেন। পরে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা নিয়মিত হন। এরই মধ্যে ডা. আবুল কালাম আজাদ একদিন বুলেটিনে যুক্ত হয়ে করোনার স্থায়িত্বকাল নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেন। তার ওই বক্তব্য নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
অনলাইন বুলেটিন স্থগিতের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. নাসিমা সুলতানা সমকালকে বলেন, বুলেটিন স্থগিত বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর বাইরে তিনি কিছুই জানেন না।
পরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নান সমকালকে বলেন, অনলাইন বুলেটিন নিয়ে একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালককে সারাদিন প্রস্তুতি নিতে হয়। এতে অন্যান্য কাজে বিঘ্ন ঘটছে। বিশেষ করে হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়নসহ অন্যান্য কাজ রয়েছে অধিদপ্তরের। এ পরিস্থিতিতে সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে অনলাইন বুলেটিন আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। বুলেটিন বন্ধ থাকলেও করোনা পরিস্থিতির বিস্তারিত তুলে ধরে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে পাঠানো হবে। সুতরাং তথ্য পেতে সমস্যা হবে না। তবে প্রয়োজন হলে আবারও বুলেটিন চালু করা হবে বলে জানান সচিব।
খবরদারি নিয়েই যত বিরোধ :গত বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। ওই সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে গণমাধ্যমে তথ্য সরবরাহ করা হতো। তখন তথ্য পেতে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু করোনার শুরু থেকে ওই কন্ট্রোল রুমকে বাদ দিয়ে তা আইইডিসিআরে স্থানান্তর করা হয়। পরে আইইডিসিআর থেকে নানা নাটকীতার পর তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে স্থানান্তর করা হয়। পৃথক করে সমন্বিত করোনা কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়। ওই কন্ট্রোল রুমের নিয়ন্ত্রণ ছিল মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালামের হাতে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তার সমন্বয়হীতা ছিল। এ কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমানকে প্রধান করে একটি মিডিয়া সেল চালু করে। ওই সময় মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয়হীতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর মধ্যেই স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামকে বদলি করা হয়। নতুন সচিব হিসেবে যোগ দেন আবদুল মান্নান। পরে বদলি হন হাবিবুর রহমান খানও। এর পর থেকে ওই মিডিয়া সেল বন্ধ হয়ে যায়। এর পর চালু ছিল শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনলাইন বুলেটিন। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে ব্যর্থতার পাশাপাশি কেনাকাটা ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এতে শীর্ষ কর্মকর্তারা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে হেলথ ইমার্জেন্সি কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তারকে মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে গণমাধ্যমে তথ্য দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর পর তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলে আসছিলেন। এর মধ্যে ডা. আবুল কালাম আজাদ ডিজির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। নতুন ডিজি হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম। প্রথমে তাকে মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলেও পরে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে আদেশ জারি করে মন্ত্রণালয়। নতুন ডিজি শুরু থেকেই গণমাধ্যম এড়িয়ে চলছেন। তার নির্দেশে একজন মেডিকেল অফিসারকে মুখপাত্র হিসেবে নিয়োগের আদেশ জারি করে দুই দিন পর আবার তা প্রত্যাহার করা হয়। একই সঙ্গে পরিচালক পদমর্যাদার একজনকে মুখপাত্র করার চিন্তাভাবনা করা হয়। এক কর্মকর্তার নাম সুপারিশ করেন মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। কিন্তু ওই কর্মকর্তা দুর্নীতিতে জড়িত থাকায় তার ওপর স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাখোশ ছিলেন। এ কারণে তাকে মুখপাত্র করা হয়নি।
স্বাস্থ্য বিভাগের একাধিক সূত্র জানায়, নতুন ডিজি অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে গণমাধ্যমের সঙ্গে কাউকে কথা না বলার নির্দেশনা দেন। একই সঙ্গে তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ আরোপ করেন। এর পরই স্বাস্থ্য অধিপ্তরের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলছেন। ডিজিই বুলেটিন স্থগিতের বিষয় নিয়ে প্রথমে কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। পরে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের সম্মতি নেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলমকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, অনেক দিন ধরে বুলেটিন প্রচার হয়েছে। এখন পরিস্থিতির আগের তুলনায় উন্নতি হয়েছে। এ কারণে সিদ্ধান্ত হয়েছে, নিয়মিত একজন ব্যক্তি দিয়ে বুলেটিন না করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে।
২৪ ঘণ্টায় ৩৩ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ২৯৯৬ :দেশে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা ও শনাক্তের সংখ্যা বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ২ হাজার ৯৯৬ জনের শরীরে নতুন করে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ২ লাখ ৬৩ হাজার ৫০৩ জনে দাঁড়াল। একইসঙ্গে ২৪ ঘণ্টায় ৩৩ জন এই প্রাণঘাতী ভাইরাসে মারা গেছেন। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা ৩ হাজার ৪৭১ জনে পৌঁছেছে। এর বিপরীতে ২৪ ঘণ্টায় আরও এক হাজার ৫৩৫ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত এক লাখ ৫১ হাজার ৯৭২ জন সুস্থ হয়েছেন।
গতকাল করোনা পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ১৫ হাজার ৩১৭টি নমুনা সংগ্রহ এবং ১৪ হাজার ৮২০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১২ লাখ ৮৭ হাজার ৮৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ২০ দশমিক ২২ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৫৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৩২ শতাংশ।
এ বুলেটিন বন্ধ করা যথাযথ হয়নি বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি সমকালকে বলেন, অনলাইন বুলেটিনের মাধ্যমে করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে মানুষকে জানানো হতো। এতে মানুষ আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য পেতেন। এখন সেটিও বন্ধ করা হয়েছে। এটি যৌক্তিক হতে পারে না। তথ্য নিয়ে লুকোচুরি ও গণমাধ্যমের মুখোমুখি হতে ভয় পাওয়া কিংবা এড়িয়ে চলার চেষ্টা সততার লক্ষণ নয়। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এ ধরনের কাজ যখন শুরু করে তখন মনে করতে হবে তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি লুকাতে চাইছে অথবা করতে চাইছে।
সংবাদ সম্মেলন যেভাবে বুলেটিন হলো :দেশে করোনাভাইরাস সম্পর্কিত হালনাগাদ তথ্য জানাতে গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলন শুরু করে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা করোনা সম্পর্কিত তথ্যউপাত্ত উপস্থাপনের পাশাপাশি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও উত্তর দিতেন। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ার পরও আইইডিসিআর পরিচালকই ব্রিফ করে আসছিলেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদও মাঝে মধ্যে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হতেন। নমুনা পরীক্ষা নিয়ে সমালোচনার মুখে চাপে পড়েন আইইডিসিআর পরিচালক। অভিযোগ ওঠে, সংবাদ সম্মেলনের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে নমুনা পরীক্ষা, কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং ও রোগতাত্ত্বিক গবেষণায় সময় দিতে পারছেন না তিনি। এ কারণে রোগটি ছড়িয়ে পড়ছে। বিষয়টি উপলব্ধি করার পর চাপ কমাতে আইইডিসিআর পরিচালকের সঙ্গে এমআইএস পরিচালক ডা. হাবিবুর রহমান ব্রিফিংয়ে যুক্ত হন। করোনার নমুনা পরীক্ষার পরিধিও বাড়ানো হয়।
এরই মধ্যে গত ২ এপ্রিল করোনার নমুনা পরীক্ষা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ভুলভাবে উপস্থাপন করেন ডা. হাবিবুর রহমান। এরপর নিয়মিত ব্রিফিংয়ে তথ্য উপস্থাপনের কাজ থেকে তাকে বিরত রাখা হয়। ৩ এপ্রিল থেকে যুক্ত হন মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ। ওই সময়ে একদিন পরপর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও অনলাইন ব্রিফিংয়ে যুক্ত হতেন। এরই মধ্যে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সর্বশেষ পরিসংখ্যান তুলে ধরে চারজনের মৃত্যুর তথ্য জানান। পরে আইইডিসিআর পরিচালক জানান, প্রকৃতপক্ষে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ ধরনের সমন্বয়হীনতায় সর্বত্র সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এর একদিন পর ৭ এপ্রিল অনলাইন বিফ্রিং স্থগিতের ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর ৮ এপ্রিল থেকে অনলাইন ব্রিফিং অনলাইন বুলেটিনে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
আইইডিসিআর থেকে নিয়ন্ত্রণ পায় অধিদপ্তর :আইইডিসিআর থেকে বুলেটিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চলে যায়। অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা শুরুতে কয়েকদিন ওই বুলেটিনে অংশ নেন। পরে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা নিয়মিত হন। এরই মধ্যে ডা. আবুল কালাম আজাদ একদিন বুলেটিনে যুক্ত হয়ে করোনার স্থায়িত্বকাল নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেন। তার ওই বক্তব্য নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
অনলাইন বুলেটিন স্থগিতের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. নাসিমা সুলতানা সমকালকে বলেন, বুলেটিন স্থগিত বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর বাইরে তিনি কিছুই জানেন না।
পরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নান সমকালকে বলেন, অনলাইন বুলেটিন নিয়ে একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালককে সারাদিন প্রস্তুতি নিতে হয়। এতে অন্যান্য কাজে বিঘ্ন ঘটছে। বিশেষ করে হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়নসহ অন্যান্য কাজ রয়েছে অধিদপ্তরের। এ পরিস্থিতিতে সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে অনলাইন বুলেটিন আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। বুলেটিন বন্ধ থাকলেও করোনা পরিস্থিতির বিস্তারিত তুলে ধরে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে পাঠানো হবে। সুতরাং তথ্য পেতে সমস্যা হবে না। তবে প্রয়োজন হলে আবারও বুলেটিন চালু করা হবে বলে জানান সচিব।
খবরদারি নিয়েই যত বিরোধ :গত বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। ওই সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে গণমাধ্যমে তথ্য সরবরাহ করা হতো। তখন তথ্য পেতে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু করোনার শুরু থেকে ওই কন্ট্রোল রুমকে বাদ দিয়ে তা আইইডিসিআরে স্থানান্তর করা হয়। পরে আইইডিসিআর থেকে নানা নাটকীতার পর তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে স্থানান্তর করা হয়। পৃথক করে সমন্বিত করোনা কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়। ওই কন্ট্রোল রুমের নিয়ন্ত্রণ ছিল মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালামের হাতে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তার সমন্বয়হীতা ছিল। এ কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমানকে প্রধান করে একটি মিডিয়া সেল চালু করে। ওই সময় মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয়হীতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর মধ্যেই স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামকে বদলি করা হয়। নতুন সচিব হিসেবে যোগ দেন আবদুল মান্নান। পরে বদলি হন হাবিবুর রহমান খানও। এর পর থেকে ওই মিডিয়া সেল বন্ধ হয়ে যায়। এর পর চালু ছিল শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনলাইন বুলেটিন। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে ব্যর্থতার পাশাপাশি কেনাকাটা ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এতে শীর্ষ কর্মকর্তারা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে হেলথ ইমার্জেন্সি কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তারকে মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে গণমাধ্যমে তথ্য দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর পর তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলে আসছিলেন। এর মধ্যে ডা. আবুল কালাম আজাদ ডিজির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। নতুন ডিজি হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম। প্রথমে তাকে মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলেও পরে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে আদেশ জারি করে মন্ত্রণালয়। নতুন ডিজি শুরু থেকেই গণমাধ্যম এড়িয়ে চলছেন। তার নির্দেশে একজন মেডিকেল অফিসারকে মুখপাত্র হিসেবে নিয়োগের আদেশ জারি করে দুই দিন পর আবার তা প্রত্যাহার করা হয়। একই সঙ্গে পরিচালক পদমর্যাদার একজনকে মুখপাত্র করার চিন্তাভাবনা করা হয়। এক কর্মকর্তার নাম সুপারিশ করেন মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। কিন্তু ওই কর্মকর্তা দুর্নীতিতে জড়িত থাকায় তার ওপর স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাখোশ ছিলেন। এ কারণে তাকে মুখপাত্র করা হয়নি।
স্বাস্থ্য বিভাগের একাধিক সূত্র জানায়, নতুন ডিজি অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে গণমাধ্যমের সঙ্গে কাউকে কথা না বলার নির্দেশনা দেন। একই সঙ্গে তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ আরোপ করেন। এর পরই স্বাস্থ্য অধিপ্তরের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলছেন। ডিজিই বুলেটিন স্থগিতের বিষয় নিয়ে প্রথমে কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। পরে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের সম্মতি নেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলমকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, অনেক দিন ধরে বুলেটিন প্রচার হয়েছে। এখন পরিস্থিতির আগের তুলনায় উন্নতি হয়েছে। এ কারণে সিদ্ধান্ত হয়েছে, নিয়মিত একজন ব্যক্তি দিয়ে বুলেটিন না করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে।
২৪ ঘণ্টায় ৩৩ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ২৯৯৬ :দেশে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা ও শনাক্তের সংখ্যা বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ২ হাজার ৯৯৬ জনের শরীরে নতুন করে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ২ লাখ ৬৩ হাজার ৫০৩ জনে দাঁড়াল। একইসঙ্গে ২৪ ঘণ্টায় ৩৩ জন এই প্রাণঘাতী ভাইরাসে মারা গেছেন। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা ৩ হাজার ৪৭১ জনে পৌঁছেছে। এর বিপরীতে ২৪ ঘণ্টায় আরও এক হাজার ৫৩৫ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত এক লাখ ৫১ হাজার ৯৭২ জন সুস্থ হয়েছেন।
গতকাল করোনা পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ১৫ হাজার ৩১৭টি নমুনা সংগ্রহ এবং ১৪ হাজার ৮২০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১২ লাখ ৮৭ হাজার ৮৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ২০ দশমিক ২২ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৫৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৩২ শতাংশ।
মন্তব্য করুন