কক্সবাজারের শৈবাল হোটেলে পর্যটকের আনাগোনা ছিল গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। একই অবস্থা ছিল অন্য হোটেল-মোটেলেও। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ফলে মার্চ থেকে পর্যটকের দেখা নেই দেশের প্রধান সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের হোটেলগুলোতে। এ অবস্থায় প্রায় পাঁচ মাস পর সোমবার থেকে কক্সবাজার সৈকত ও সেখানকার অন্যান্য বিনোদনকেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়েছে। গতকাল প্রথম দিন হওয়ায় পর্যটকদের উপস্থিতি কম ছিল। এ দিন অন্তত তিন হাজার পর্যটক সৈকত ভ্রমণ করেন। করোনার সংক্রমণের কারণে গত ১৮ মার্চ কক্সবাজার সৈকতে পর্যটক আগমন নিষিদ্ধ করেছিল জেলা প্রশাসন। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে প্রশাসন কঠোর অবস্থানে রয়েছে।

এ শিল্পে জড়িত ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে একমাত্র কুয়াকাটা ছাড়া দেশের অন্য পর্যটনকেন্দ্রগুলো দর্শনার্থীশূন্য। তাদের মতে, এর আগেও নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেছে পর্যটন খাত। তবে প্রাণঘাতী করোনায় এমন বিপর্যয় দেখা দিয়েছে যে মৃতপ্রায় পর্যটন শিল্প আগামী দু-তিন বছরেও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।

জানা গেছে, বর্তমানে পর্যটন শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৪০ লাখ লোক জড়িত। সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এর ৯০ শতাংশই বর্তমানে কর্মহীন। হোটেল-আবাসন, পরিবহন, বিনোদনসহ এর সঙ্গে ১৬টি উপখাত জড়িত। একমাত্র ট্যুর অপারেটর ছাড়া বাকি সব খাতই বন্ধ রয়েছে বলে জানান সংশ্নিষ্টরা।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মহিবুল হক বলেছেন, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ খাত ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে। ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সাবেক সভাপতি হাসান মনসুর বলেন, 'নিকট অতীতে পর্যটন শিল্পে এমন খারাপ অবস্থা আর কখনও দেখা যায়নি। এ খাতের সবই মৃতপ্রায়। বেঁচে থাকাই এখন দায়।'

বিশ্ব পর্যটন সংস্থা এর আগে ২০২০ সালকে পর্যটন শিল্পের জন্য সম্ভাবনাময় বছর হিসেবে বিবেচনা করেছিল। করোনার কারণে তা ভেস্তে যেতে বসেছে। সংস্থাটির তথ্যমতে, গত মার্চে বিশ্বে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৭ শতাংশ পর্যটক কমেছে। আর এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এশিয়া এবং প্যাসিফিক অঞ্চল। বিশ্বব্যাপী লকডাউন জোরদার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পর্যটকের সংখ্যাও দ্রুত হ্রাস পেয়েছে।

সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে গত বছর মোট পাঁচ লাখ বিদেশি ভ্রমণ করেছেন। অথচ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এসেছেন মাত্র ৫০০ জন। এর পর থেকে আসা বন্ধ রয়েছে। টোয়াবের বর্তমান সভাপতি রাফিউজ্জামান আশা করেছেন, আগস্টের পর সবকিছু স্বাভাবিক হবে। পর্যটকরা আসতে শুরু করবেন। কিন্তু করোনা দীর্ঘস্থায়ী হলে অনিশ্চয়তা বাড়বে। তিনি সমকালকে বলেন, আয় তো দূরে থাক, এ খাতের লেনদেনই নেই। এভাবে চলতে থাকলে বেশিদিন টিকে থাকা সম্ভব নয়।

এক প্রশ্নের জবাবে টোয়াব সভাপতি বলেন, কমপক্ষে দু-তিন বছরের আগে পর্যটন শিল্প ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নেই। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি জানান, ভ্রমণের জন্য প্রধানত দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। অনুকূল পরিবেশ, অর্থাৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া এবং হাতে উদ্বৃত্ত টাকা থাকা। সেই পরিস্থিতি আসতে সময় লাগবে।

বাংলাদেশে পর্যটন একটি উদীয়মান শিল্প বলে মনে করা হয়। তবে কয়েক বছর ধরে এ শিল্প হাঁটিহাঁটি, পা-পা করে এগোচ্ছে। করোনাভাইরাসের আকস্মিক প্রাদুর্ভাবে এ খাতে ধস নেমেছে। প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের (পাটা) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের এক সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পর্যটন শিল্পে ৯ হাজার ৭০৫ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে টোয়াবের তথ্য অনুযায়ী, করোনায় এ খাতে ক্ষতির পরিমাণ ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড আশঙ্কা করছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশের পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত ৫০ শতাংশ কর্মী চাকরি হারাতে পারেন। সংশ্নিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, বাংলাদেশের পর্যটন খাত পর্যালোচনা করার জন্য যে তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন, তা সঠিকভাবে পাওয়া যায় না। এ পর্যন্ত যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির কথা আলোচনা হয়েছে, তা সবই অনুমাননির্ভর। প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ এর চেয়ে অনেক বেশি।

সংশ্নিষ্টরা বলেছেন, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্প গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বছরে ১০ লাখ অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটক পাওয়া গেলে এক কোটি লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার সুফল ভোগ করবে।

বর্তমানে সারা বিশ্বে দ্রুত বর্ধনশীল কয়েকটি শিল্পের মধ্যে পর্যটন অন্যতম। জানা গেছে, বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের হোটেল ও বিমান মিলে ১০ ভাগ ব্যবসায়ী করপোরেট শ্রেণির, মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ৮০ ভাগ এবং ১০ ভাগ প্রান্তিক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। ফলে পর্যটনের সঙ্গে ৯০ ভাগ পেশাজীবী ও কর্মী নাজুক অবস্থায় রয়েছেন।

বাজেটে অপ্রতুল বরাদ্দ :সংশ্নিষ্টরা বলছেন, বাজেটে বরাবরই অবহেলিত থেকে যায় পর্যটন খাত। মোট বাজেটের ১ শতাংশেরও কম এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে মনে করেন সংশ্নিষ্টরা।

চলিত অর্থবছরে রাজস্ব এবং উন্নয়ন মিলে পর্যটন খাতে বরাদ্দ তিন হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা। এই বরাদ্দ মোট বাজেটের মাত্র শূন্য দশমিক ৬৩ শতাংশ। এ বরাদ্দের বড় একটি অংশ ব্যয় হয় বেতনভাতাসহ আনুষঙ্গিক খাতে। অবকাঠামো উন্নয়নে নামমাত্র বরাদ্দ দেওয়া হয়।

ট্যুর অপারেটররাসহ সংশ্নিষ্টরা বলেছেন, সরকার বিভিন্ন শিল্পের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। সেখানে পর্যটনের মতো বৃহৎ শিল্পটি রয়ে গেছে অবহেলিত। অথচ, পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত আছে কয়েক লাখ ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প। করোনা পরিস্থিতিতে মধ্যে বেশিরভাগ শিল্পই আছে ঝুঁকির মুখে। এসব শিল্পকে সহায়তা না করা হলে টিকে থাকতে পারবে না। তারা বলছেন, অন্যান্য শিল্পের মতো পর্যটন খাতের জন্যও দরকার স্বল্প, মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।